কালিয়া
-“আব তেরা ক্যা হোগা রে কালিয়া ?”
-“সরদার আপকা নমক খায়া “
-“তো আব গোলি খা “
-হাহাহা হাহাহা হাহাহা ”
খবরদার যেন বলবেন না যে আপনি এগুলো আগে শোনেননি। তাহলে নিসন্দেহে আপনি একজন ক্যাবলা মানুষ। মুটে -মজুর-দলিত-কিষান, নিরক্ষর-স্বাক্ষর-বিদ্বান , রণে-বনে-জঙ্গলে, ঝোলে-ঝালে-অম্বলে, রকে-ঠেকে-লেকে, দাঁড়িয়ে-ঝুলে-বেঁকে, ঝুলন্ত-ডুবন্ত-গঙ্গাজল মুখে, যেকোনও অবস্থায় ভারতবাসী বলে দিতে পারবে এটা আমাদের ভারতবর্ষের তৃতীয় মহাকাব্য “শোলে ” এর ডায়ালগ।
বাল্মীকি , বেদব্যাস মুনিদের কপিরাইট গেছে বহুকাল। চোপড়া সাহেব,রামানান্দবাবুরাই আমাদের আসল মহাভারত, রামায়ন দর্শন করিয়েছেন। হ্যাঁ, এবং অব্যশই সিপ্পি সাহেব – যিনি জন্ম দিয়েছেন তৃতীয় মহাকাব্য “শোলে “-র ।
সেই মহাকাব্যের একটি উপেক্ষিত চরিত্র “কালিয়া”। আসলে “কালিয়া ” শুনলে এক একজন মানুষের সামনে একেকটা ছবি ভেসে ওঠে। তার মধ্যে যে কটা আমার গোচরে এসেছে তাদের নিয়েই লিখছি আজ।
দুদুটো গুলির ফাঁকা আওয়াজের পর গব্বর সিংহ এসে দাঁড়ান তৃতীয় ব্যক্তির কাছে।
“এবার তোর কি হবে রে কালিয়া ?’
গব্বর এর বিশ্বস্ত সেনাপতিদের একজন এই কালিয়া। লম্বা গুম্ফ , প্রশস্ত জুলফিওয়ালা দস্যু। সর্দারের নুন খাওয়া সেবক। জয়-বিরুর কাছে বেধড়ক ধোলাই খেয়ে পর্যদুস্ত হয়ে ফিরে যথারীতি রামবকুনি খেতে হচ্ছে গব্বর এর কাছে। “হারামজাদা”, “বরাহনন্দন” এর মতো গালাগাল-ও জুটেছে তিরস্কার স্বরূপ। তাতে কি হয়েছে? ক্লাস ফাইভে অঙ্কে ফেল করার পর বাড়ি ফিরে বাবার কাছেওতো কত্ত বকুনি খেতে হয়েছিল তাকে। গব্বর কি তার বাবার থেকে কিছু কম ? নিজের হাতে বন্দুক চালানো, ঘোড়ায় চড়া , পাহাড়ে চড়া আরো কত কিছু তাকে শিখিয়েছে।
আর একটা ব্যাপারে সে খুব কৃতজ্ঞ সর্দারের কাছে। ছেলেবেলায় তার নাম নিয়ে পাড়ায় কি অসভ্যতাই না হতো ! কেউ ডাকতো “কালু”, কেউ “কেলো” , কেউ “কালা” – বাপমায়ের দেওয়া নাম নিয়ে কি অসভ্যতা ! সেই দিক থেকে তাদের দস্যুসমাজ অনেক ভদ্র। সর্দার প্রথমদিনই বলে দিয়েছিলো “নাম লে কর কয়ি ছেড়খানি নহি” – মানে নামের কোনরকম শ্লীলতাহানি করা চলবে না। তাইতো না সে সকলের কালিয়া হয়ে রয়ে গেছে। ছি ছি ছি সেই সর্দারের মুখে চুনকালি মাখিয়ে ফিরলো সে!
সেদিনের সেই অগ্নিপরীক্ষাতে অবশ্য উত্তীর্ন হয়েছিল কালিয়া। মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে ট্রিগারে আঙুল দিয়ে সর্দার মেতেছিল সেই ভয়ংকর খেলায়। প্রথম দুটো বুলেট ফাঁকা বেরিয়েছিল। তৃতীয় গুলিটাও যখন ফাঁকা বেরোলো, তখন সর্দার বললো “তিনটে হারামজাদাই বেঁচে গেল রে”। বলে সে কি হাসি ! সর্দারেরতো মুড্ বোঝা দায়। হাসি মানে যে হাসি-ই , সেটা নাও হতে পারে। কখনো হাসি মানে ” বিদ্রুপ”, কখনো “তিরস্কার”, এমনকি কখনো বা “কান্না” । তাই খুব সাবধানে চারিদিকে তাকিয়ে যখন সে দেখলো দলের সবাই-ও হাসছে সর্দারের সাথে সাথে, তখন কালিয়াও খুব হেসেছিলো ।
এই হলো আমাদের প্রথম কালিয়া। হেভিওয়েট সিনেমার হেভিওয়েট চরিত্রদের মাঝেও স্বনামধন্য।
আমাদের প্রথম কালিয়া অনেকটাই “কাব্যে উপেক্ষিত” হলেও দ্বিতীয়জন “আইকনিক ক্যারেক্টার”, যার নামভূমিকায় সুপারস্টার অমিতাভ বচন । কালিয়া সিনেমার কালিয়া। কয়লাখনির শ্রমিক – সারাক্ষন মুখে কালিঝুলি মেখে থাকেন(কখনো মুখ ধোন না ) – কম কথা বলেন – খুব গম্ভীর – অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্ছার। জলদগম্ভীর কন্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে চিড়বিড়িনি ধরান ভিলেনদের। ল্যাটা হাতে “পোচুর ঢিসুম ঢিসুম” করেন – জলে-স্থলে-পাতালে। একেবারে সুপারহিট সিনেমা। চারিদিকে তখন অরাজকতা – কলকারখানা বন্ধ – শ্রমিক আন্দোলন – ধর্মঘট । বামপন্থীদের রমরমা বাজার। মানুষের দুখঃ-দুর্দশার কোনো অন্ত নাই। প্রচুর বেকার ছেলে-পিলে, যাদের চাকরি নেই, পাবার আশাও নেই। এই শাসন-শোষণ-বঞ্চনার নৈরাজ্যের অবসান ঘটাতে ভগবানও এমুখো হচ্ছেন না বহুকাল। অতএব “গুরু”-ই একমাত্র ভরসা। তিনিইতো কখনো ‘মর্দ’, কখনো ‘কুলি’, কখনো ‘ডন’, আবার কখনো ‘কালিয়া’ হয়ে তাদের পরিত্রাতা। অন্তত ৩ ঘন্টার জন্য। একেকবার গুরু আসবে , গরম গরম ডায়ালগ ঝাড়বে, আর হল ফেটে পড়বে সিটি-তে আর ‘গুরুগুরু’ আওয়াজে।
শেষ দৃশ্যে গুরু যখন বেলচা-কোদাল নিয়ে ভিলেন বধে “পোচন্ড ” কেলাকেলি করছে। একবার ডিগবাজি খেয়ে এপারে , আর একবার লাফিয়ে ওপারে। একবার গুরু মারেতো , একবার ভিলেন। ওফ, কি টেনশান কি টেনশান । কিন্তু ঠিক জানি শেষে জয় হবে গুরুর-ই।
এ হলো একেবারে পয়সা-উসুল “কালিয়া”। তবে এখানে “গুরু”-ই প্রধান, কালিয়া নিমিত্ত মাত্র।
তবে বাঙালীর কাছে কালিয়া নামের মাহাত্ম্য-ই আলাদা।। মননশীল বাঙালী, ভ্রমণ পিপাসু বাঙালী, আঁতেল বাঙালী , সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালী; সর্বোপরি খাদ্যরসিক বাঙালী। জল ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, মাছ ছাড়া বাঁচেনা বাঙালী। অতএব সেই বাঙালীর কাছে প্রধান কালিয়া হলো “মাছের কালিয়া”। রুই কিংবা কাতলা মাছের একটি রাজকীয় ডিশ। যার দেখা মেলে ট্রাডিশনাল বাঙালীর অনুষ্ঠান বাড়িতে।
রুই-কাতলার খাম্বা খাম্বা টুকরো, সর্ষের তেলের ঝাঁজে, পেঁয়াজ-রসুন-আদায় ভেজে নেড়ে, মশলায় সম্পৃক্ত করে, কাবা কাবা আলু সহযোগে লাল-হলুদ বর্ণের উচ্ছাসে যে তরল রূপ ধারণ করে বাঙালির রসনা তৃপ্ত করে, তাই “কালিয়া”।
একসময় বাঙালীর অনুষ্ঠান বাড়ির এক অন্যতম আকর্ষণ ছিল এই কালিয়া। ‘ছিল’ বলছি কারণ বিগত কয়েক দশকে বাঙালীর অনুষ্ঠান বাড়ির মেনুতে ঘটে গেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। মোগলাই, চাইনিজ, থাই, কন্টিনেন্টাল, এবং সর্বোপরি ফিউসন ডিশ, এটাই যুগের প্রবণতা (ট্রেন্ড)।
কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় কালিয়া ছিল বিয়ে বাড়ির প্রধান আকর্ষণ। কারণ আমাদের মা-জেঠিমারা বাড়িতে কালিয়া বানালেও ছেলেবুড়োদের স্বাস্থ্যের কারণে (সেকালের যৌথ পরিবারে, এক-আধটা পেটরোগা ছেলেপিলে , কিংবা নোলা বুড়ো ঠিক থাকতোই থাকতো ) তেল-ঝাল-মশলার পরিমান অনেক কমিয়ে দিতেন। তাই কালিয়ার কালিয়াত্ব, অর্থাৎ X-factor বজায় থাকতো না।
এই কালিয়া নিয়ে কাজিয়া বেঁধে গেলো সেদিন আমার বাড়িতে।( তখন কি জানতাম আরেক কালিয়া “গোপনে বাড়িছে”!)
জিকো বরাবরই মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। ওর মধ্যাহ্নভোজের একটা প্রিয় আইটেম ওর দিদির (দিদিমা) হাতের তৈরি মাছের ঝোল। নানারকম সবজি আর আলুর সাদামাটা ঝোল , কিন্তু স্বাদ ও পুষ্টি গুনে উৎকৃষ্ট। সেদিন বাড়িতে একেবারে সাদামাটা ঝোল না করে জিকোর দিদি একটু অন্যরকম ঝোল বানিয়েছে। যেকোনো নতুন জিনিসে আবার জিকোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াই নেতিবাচক। তাই জিকোকে রাজি করাতে নতুন নতুন কৌশল নিতে হয় আমাদেরও।
তাই সেদিনও যখন জিকো স্নান সেরে খাবার টেবিলে প্রস্তুত, তখন ওর দিদি ঘোষণার ভঙ্গিতে জানালো “আজ জিকোর জন্য দারুন একটা খাবার – কি tasty , কি ভালো – মাছের কালিয়া “।
কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে শুনলো জিকো, তারপর তীব্র প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বললো “না না আমি কালিয়া খাবো না| কিছুতেই খাবো না |”
আমরা যথারীতি ধরে নিলাম এটা ওর স্বভাবধর্মী প্রতিক্রিয়া। একটু ভুলিয়ে-ভালিয়ে একটা-দুটো গ্রাস খাইয়ে দিলেই ওর মত্ পরিবর্তন হয়ে যাবে। তাই জিকোর দিদি শুরু করলো সেই প্রক্রিয়া। কিন্তু যতই বোঝানো হোক, কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছে না ওকে । একেবারে কেঁদেকেটে শরীর বেঁকিয়ে প্ৰত্যাখ্যান করছে বারেবারে। “কিছুইতেই আমি কালিয়া খাবো না। … .কালিয়া বাজে …কালিয়া পচা ” ।
অচিরেই পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হলো। ওরে মা-বাবা-দাদু-দিদি , মানে গোটা ফ্যামিলি ওরে পাশে। আমরা জানতে চাইলাম, কেন কালিয়া ‘বাজে’, ‘পচা।
অনেক জিজ্ঞাসা-অনুনয়-বিনয়ের পর কেঁদে কেঁদে বললো “কালিয়া খুব বাজে। ও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খপাৎ করে ধরে খেয়ে নেয়।।”
মুহূর্তের মধ্যে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হলো। কদিন আগেই জিকো ওর মায়ের সঙ্গে বসে পড়েছে অমরচিত্রকথা (বাংলায় ছবিতে গল্প ) “ছোটদের কৃষ্ণ”। সেই বইতে বালক কৃষ্ণ-র “মাখন চুরি” , ‘গোপিনীদের জামাকাপড় লুকোনো” এরকম নানারকম কাহিনী আছে।
দ্বাপর যুগের সেই অবতার কৃষ্ণের আর একটি মনমোহিনী কাহিনী “কালিয়া দমন”। কালিয়া ছিল সহস্রমুখী এক বিষধর সর্প। বৃন্দাবনের কাছে যমুনা নদীতে সে আশ্রয় নিয়েছিল। সেই সাপের অত্যাচারে যখন বৃন্দাবনের মানুষ অতিষ্ঠ তখন বালক কৃষ্ণ তাকে দমন করেছিলেন। সেই কাহিনী যে শিশুমনে এতটা প্রভাব ফেলবে তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। সত্যিইতো, বিষধর, অত্যাচারী, ‘বাজে’ , ‘পচা’ এক সাপ যদি lunch menu তে এসে উপস্থিত হয়, তাহলেতো তা বিশেষ আপত্তির কারণ হতেই পারে।
অতএব দ্বাপরের পর এই কলিযুগেও আর একবার দমন করতে হলো কালিয়াকে। জিকোকে বোঝানো হলো যে এটা সেই কালিয়া নয় । এটা সাপ নয় ,মাছ। তার ভালোবাসার “জিজি মাছ”। এতঃপর ” খোকা বুঝিলো, ভাত খাইলো, শান্তি এলো ঘরে”|
সেদিন বয়েসের কারণে যা বোঝানো গেলো না, তা জিকো বড় হয়ে নিশ্চই একদিন বুঝবে। তার পাতে সেদিন যা দেওয়া হয়েছিল সেটা “সহস্রমুখী সর্প ” নয়। সে ছিল আমাদের “বহুধামুখী দর্প”- “শিরোন্নত বাঙালির গর্বের, অহংকারের এক ঐতিহ্যবাহী প্রকাশ – মাছের কালিয়া “।