নিরাপত্তা
জিকোর প্রথম এরোপ্লেন চড়া নমাস বয়সে – হিউস্টন থেকে হনুলুলু । তারপর বহুবার – কয়েক মাস অন্তর অন্তর – কখনো ডোমেস্টিক, কখনো ইন্টারন্যাশনাল । আকাশ বরাবরই হাতছানি দিয়ে ডাকে ছোটদের । ছোটবেলায় আমাদেরও ডাকতো ।
আমাদের দমদমের বাড়ির খুব কাছেই এয়ারপোর্ট । যতটা কাছে বলছি ছোটবেলায় অবশ্য ততটা কাছে ছিল না । এয়ারপোর্ট হোটেলের মাথার উপর একটা আলোকিত ‘t’ আমাদের ছোটদের সারাবছর টানতো দুর্নিবার আকর্ষণে । তাই একবার পুজোয় আমাদের ভাইবোনেদের দলের গোপন অভিযানের ডেস্টিনেশন হলো এয়ারপোর্ট ।
আমাদের মধ্যে যারা বড় তাদের তত্ত্বাবধান ও খবরদারিতে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছলাম সেই চত্বরে। সামনে একটা বড় বাগান । সেখানে প্রত্যেক গাছের গোড়ায় বসে আছে জোড়া জোড়া যুবক-যুবতী । আমরা বসে পড়লাম মাঠের মাঝখানে – গোল হয়ে । সকলের হাতে এক একটা চিনেবাদামের ঠোঙা ।সামনে আলোকিত বর্ণময় এয়ারপোর্ট । এক একটা করে এরোপ্লেন নামছে আবার এক একটা করে উঠছে । আমাদের উত্তেজনার পারদও নামছে আর উঠছে । এক একটা গাড়ী এসে থামছে, সেখান থেকে নামছে সুবেশী নারী-পুরুষ ; কখনও হ্যান্ডসাম পাইলট; কখনওবা এক ঝাঁক সুন্দরী বিমানসেবিকা। তারপর “তোমরা হাসিয়া বহিয়া চলিয়া যাও ” এর মতো করে চলে যাচ্ছে এয়ারপোর্টের ভেতরে ।
সেই জাদুনগরের মোহে সকলে আমরা বিভোর হয়ে পড়েছিলাম । এরপর বহুদিন আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল শুধু এয়ারপোর্ট । কতবার স্বপ্নে ওই আলোকময় যন্ত্রযানে চেপে পাড়ি দিয়েছি দূর দিগন্তে তার ইয়ত্তা নেই । কিন্তু ওই পর্যন্তই – ” ভেতরে প্রবেশ করি সে সাধ্য ছিল না একেবারে ” । কারণ তখন বিমান ছিল শুধু এলিট ক্লাসের জন্য – মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে ।
এরপর গ্লোবাল ইকোনমির জোয়ারে বিমানভাড়া এসে দাঁড়ালো মধ্যবিত্তের সাধ্যের নাগালে । কিন্তু ৯/১১ -র পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন এয়ারপোর্টের যা হাল, তাতে সাধ্যে কুলালেও আকাশচারী হবার সাধ গেছে ঘুচে । এয়ারপোর্টে পদার্পণ থেকে প্রতি পদক্ষেপে কিছু না কিছু প্রমাণ করে এগিয়ে যেতে হয় পরবর্তী পরীক্ষা কেন্দ্রে । বার চারেক আত্মপরিচয় দেওয়া – অর্থাৎ “আমি যে আমিই” তার প্রমাণ দাখিল করা । এরপর পরীক্ষার পালা আমার ব্যাগের। তার ভিতরে যে বোমা বারুদ পিস্তল নেই তার নিশ্চত প্রমাণ । অবশেষে বেল্ট, জুতো, টুপি, মাফলার ইত্যাদি খুলে নিরাপত্তা বলয়ে প্রমাণ করা যে আমি উগ্রপন্থী নই । বলা চলে আমার চরিত্রের শেষ স্ক্যানিং। দিগম্বর হয়ে দুহাত তুলে ‘ট্যা ট্যা দরজা’ পেরিয়ে এসে দাঁড়াই পোডিয়ামে । যেই না আমার বোর্ডিং পাস এ ‘ধাপ’ করে একটা স্ট্যাম্প পড়ে যায়, ওফ মনে হয় অলিম্পিক স্বর্ণপদক বিজয়ী আমি ( কি আশ্চর্য তখন যে আমি পোডিয়ামেই দাঁড়িয়ে !) ।
এয়ারপোর্টের গেট থেকে এই হার্ডলস-চক্র পেরিয়ে অবশেষে যখন সিটে বসতে পারি, তখন ভিতর থেকে আপনা আপনি বেরিয়ে আসে এক অস্ফুট দীর্ঘ নিঃশ্বাস ‘ওওফফ’ ।
শুনেছি বছর পঁচিশেক আগেও নাকি বিমানের এত কাছাকাছি যাওয়া যেত যে বিমানযাত্রীর আত্মীয়-স্বজন প্রায় কোলে করে বিমান থেকে নামাতো তাদের বিদেশ ফেরত ছেলেমেয়েদের । অথবা অশ্রুসজল বিদায়ের মুহূর্তে তাদের বাছাকে এরোপ্লেনের ভেতরে সিট ঝেড়ে মুছে বসিয়ে তবে ক্ষান্ত হতেন। তাদের কষ্টে বিমানসেবিকাদেরও বুক কেঁদে উঠতো। সবাইকে জলটল খাইয়ে, চোখের জল মুছিয়ে বিমানের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামিয়ে তবেই তাদের শান্তি হতো ।
এও আমার এক শোনা গল্প – একবার এক ভদ্রমহিলা নাকি খুব কাঁদছিলেন তার ছেলের সাথে আসন্ন বিচ্ছেদ বেদনায় । ছেলে যাচ্ছে আমেরিকায় পড়তে । এই এতটা পথ তার একরত্তি ছেলে একা যাবে এই আশঙ্কায় তার কান্নার তীব্রতা দমকে দমকে বাড়ছিল । এই দেখে এয়ার ইন্ডিয়ার এক বিমান সেবিকা এগিয়ে এসে তাকে আশ্বস্ত করে – “চিন্তা করবেন না ম্যাডাম, আমি তো আছি । আমি আপনার ছেলের দেখভাল করবো “। এরপর দুচার কথায় প্রকাশ পায়, আজ থেকে ৩০ বছর আগে এমনই এক এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ভদ্রমহিলার স্বামী যখন বিদেশ যাচ্ছিলেন, তখন এই বিমানসেবিকা ই ছিলেন ।
পাশে বসা এক অত্যুৎসাহী মেসোমশাই গোছের লোক বলে উঠলেন – “আহা কি সার্ভিস!! বাবা থেকে ছেলে !! ভাবা যায় !! একে বলে পরম্পরা “।
পিছন থেকে এক চ্যাঙড়াগোছের ছেলে বলে উঠলো – “সবি ভাগ্য কাকু ! বাবা পেলো বউয়ের মতো ভালোবাসা, আর ছেলে পেলো মায়ের মতো !! ” এই বলে কানে হেডফোন লাগিয়ে চোখ বুজে সেই যে ডুব দিল আর উঠল না কয়েক ঘন্টায় ।
আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ, জন্মেছি ভুল সময়ে এবং ভুল পরিবারে, তাই এসব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পারিনি । ফিরে আসি আমাদের সময়ের কথায় ।
আমাদের প্রতিটি বিমান যাত্রায়, আমরা যখন ব্যতিব্যস্ত এয়ারপোর্টের ভিতর, তখন জিকো কিন্তু মগ্ন তার জগতে । cart, baggage, scanner থেকে বোর্ডিং পাস সবকিছুই ওর কাছে আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান। সবথেকে আকর্ষনীয় স্থান ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে কাঁচের দেয়াল এর মধ্যে দিয়ে এরোপ্লেন দেখা । কোনোটা এইমাত্র ভূমিষ্ঠ হলো । কোনোটা উড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছে । এর মধ্যে অসংখ্য মানুষের কর্মব্যস্ততা , গাড়ি ঘোড়ার ছুটোছুটি । কোনটা মাল বহন করছে, কোনটা তেল ভরছে। কেউ একটা লম্বা লাঠি দিয়ে এয়ারক্রাফটের বাইরেটা পরিষ্কার করছে , কেউ হাতের বিভিন্ন মুদ্রায় দিকনির্দেশ করছে পাইলটকে । আসলে কোন একটা জায়গায় এত প্রকার কর্মকাণ্ড একসাথে তো চোখে পড়ে না । এয়ারপোর্ট সবসময়ই তাই ছোটদের কাছে খুব আকর্ষণীয় ।
বছর দুয়েক আগের কথা – জিকোর তখন চার বছর বয়েস । কলকাতা থেকে সদ্য ফিরেছি হায়দ্রাবাদে । বাইরের দালানে জিকো তখন খেলছিল । মুখ দিয়ে লাগাতার যে শব্দ করছিল তার গতিধারা ও তীব্রতার উত্থান-পতনে আন্দাজ করছিলাম, খেলার বিষয়টা । একের পর এক প্লেন রানওয়ে দিয়ে দৌড়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে । আমি ভিতরের ঘরে কাজ করছিলাম । হঠাৎ ও দৌড়ে এলো আমার কাছে – হাতে বোর্ডিং পাস । ” বাবা বাবা, উঠে দাঁড়াও । আমি সিকিউরিটি – তুমি হাত তুলে দাড়াও- আমি তোমার বগল চুলকে দি ” । এই অভিনব প্রস্তাব এর অর্থ প্রথম ঝটকায় বুঝতে পারিনি । তারপর যখন বুঝতে পারলাম, তখন সেই অভিনব দৃশ্য কল্পনা করে হাসির দমকে ফেটে পড়লাম ।
প্রতিবার এয়ারপোর্ট এ সিকিউরিটি চেকইন এর সময় ও দ্যাখে , আমরা যারা ছেলে তাদের , পোডিয়াম এর উপর হাত তুলে দাঁড়াতে হয় । নিরাপত্তাকর্মী তার হাতের যন্ত্র দিয়ে প্রথমে স্ক্যান করে আমাদের শরীর । তারপর হাত দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশের তল্লাশি চালায় । বহুবার দেখা এই দৃশ্য, শিশুমনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন তুলেছে, কেন এই প্রক্রিয়া ? কি করে ওরা ? অবশেষে খুঁজে পেয়েছে এই উত্তর – যাত্রীসাধারণের সেবায়, এই বিশেষ ভঙ্গিমায় বগল চুলকে দেওয়াই “security procedure” এর উদ্দেশ্য ।
কল্পনার এই অভিনবত্বে যে মজা আছে , অনেক নিকটজনের সাথেই সেই মজাটা ভাগ করে নিলাম এই গল্পটা বলে । কিন্তু কোথাও যেন মনে হলো, শিশু মনের এই ভাবনা কি নেহাতই বিচ্ছিন্ন ? নাকি প্রচ্ছন্ন আছে অন্য কিছু ? হয়তো এক আশাবাদী মনের স্বপ্ন । যে স্বপ্ন দেখেছেন যুগে যুগে কত কবি কত শিল্পী । হয়তো এই স্বপ্নেই বিভোর কবি সৈয়দ কাদরী লিখেছিলেন – ” প্রিয়তমা , ভয় নেই – এমন দিন এনে দেবো, যেদিন সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, গোলাপের তোড়া হাতে করবে কুচকাওয়াজ ” । এ স্বপ্ন কি শুধুই অলীক?
একমুঠো অন্নের জন্য হাহাকার করছে একদিকে একদল মানুষ । এক সীমান্ত থেকে অন্য সীমান্তের প্রতিরোধের মাঝখানে দিশেহারা একদল মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের আইডেন্টিটি । বারুদময় বাতাসে জন্ম নেওয়া শিশু নিঃশ্বাস নিতে চাইছে একটু তাজা বাতাসে । অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে সারা পৃথিবীতে চলছে স্বাধীনতা উগ্রপন্থার দ্বন্দ্ব ।একদল মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে ঈশ্বরের সেই অবতারকে, যার আসার কথা ছিল অধর্মের বিনাশে যুগে যুগে । অন্যদিকে কেউ গাইছে ” imagine there’s no heaven /its easy if you try / no hell below us / above us only sky ” ( John Lennon ) সমবেত মানুষের চেতনা থেকেইতো জেগে ওঠে বিপ্লব । উড়ন্ত পাখির দিকে তাকিয়ে আকাশে উড়ার যে কল্পবিজ্ঞান , তার থেকে স্বপ্ন ধার নিয়েই তো গড়ে ওঠে হাওয়াই-বিজ্ঞান (aerodynamics) । যে মানুষ ঊর্ধ্বমুখে তাকিয়ে ঈশ্বর খুঁজছে , তারা হয়তো একদিন দেখবে আকাশ থেকে “প্যারাট্রুপার” এর মতো নেমে আসছে ” চকলেট টফি রাশিরাশি ” । প্রতিরোধহীন সীমান্ত পেরিয়ে সাঁজোয়া গাড়ির ঝাঁক এসে দাঁড়িয়েছে তোমার আমার উঠোনে – “বেহালা গিটার বাঁশি হারমোনিকা নিয়ে ” । বিমানবন্দরগুলো আবার হয়ে উঠবে মুক্তাঞ্চল । ‘পিঠ চুলকে’ না দিলেও, নিরাপত্তা বাহিনী হাসিমুখে স্যালুট করে তোমাকে আমাকে করবে অভিবাদন । তুমি আমি যখন উড়ে যাব আকাশপথে, তখন তারা নিচ থেকে হাত নেড়ে বলবে, “যাত্রা শুভ হোক, আবার দেখা হবে বন্ধু” ।
you may say I am a dreamer
but I am not the only one
I hope someday you’ll join us
And the world will leave as one
~~