মধ্যপদলোপী
চায়ে চুমুক দিতে দিতে আর একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলো সুপ্রকাশ। খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে , কিন্তু কোথায় যে দেখেছে সেটা মনে পড়ছে না। ইতিমধ্যে তিন কাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে। খবরের কাগজটাও বেশকয়েকবার ওল্টানো হয়ে গেছে। কিন্তু এবার না উঠলেই নয়। বেশি দেরি হলে আবার মন্দিরা চেঁচামেচি করবে। তাছাড়া এখন যেরকম রোদ চড়ছে তাতে মাছগুলো খারাপ হয়ে যেতে পারে। যদিও বরফ দেওয়া আছে।
প্রতি রোববার এই এখানে আসে সুপ্রকাশ। সপ্তাহে এই একদিন মাছের বাজার বসে এখানে। জায়গাটা ন্যাশনাল হাইওয়ের ধারে। এই দিকটা তার ছোটবেলায় কেউ আসতো না। কিন্তু এখন বেশ ভালোই বসতি গড়ে উঠেছে। আর হয়েছে বেশ কয়েকটা ধাবা।
মাছ কেনার পর নিয়ম করে এই “জলন্ধর ” ধাবাতে বসে তিনি ওমলেট সহযোগে চা খান। আজ সকালেও তেমনি এসেছিলেন। অভ্যেসমতো বসেছিলেন বাইরের উঠোনের খোলা অংশটায়। এতো সকালে লোক খুব একটা বেশি থাকে না, তাই প্রত্যেক সপ্তাহে মোটামুটি একই টেবিলে বসেন তিনি।
আজও অভ্যাসমতো বসেই সামনে রাখা খবরের কাগজটা ওল্টাচ্ছিলেন। গতকালের কাগজ। এখানে দিনের দিনের কাগজ আস্তে একটু বেলা হয়। ইতিমধ্যে চা এসে গেছে। তাকে বলতে হয়না। দোকানের সবাই তার খুব চেনা।
সবে দুএকটা চুমুক দিয়েছেন, হঠাৎ চোখে পড়লো ধাবার ভিতরে বসে থাকা একটা লোকের দিকে। প্রথম দেখাতেই মনে হলো ভীষণ চেনা। খুব মনোযোগ দিয়ে লোকটা কিছু একটা খাচ্ছে – খুব সম্ভবত পাঁউরুটি আর ঘুগনি – এটা এখানকার খুব বিখ্যাত। এখান থেকে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সকালের আলো এখনো ততটা জোরালো নয়। ধাবার ভিতরে সে আলো আরো দুর্বল। একেবারে কোনার দিকের টেবিল বসে লোকটা। মাথায় চুল বেশ ঘন কিন্তু প্রায় সবই পাকা। একমুখ ভর্তি দাড়ি। একটা কালো জামা পড়ে আছে। দেখলে মনেহয় খুব একটা অবস্থাপন্ন ঘরের নয়।
খেতে খেতে মাঝে মাঝে মুখ তুলে তাকাচ্ছে, আর তখনই সুপ্রকাশ ভালো করে দেখতে পাচ্ছে ওর মুখটা। এতো চেনা মনে হচ্ছে , অথচ কিছুতেই স্মৃতির জালে ছেঁকে তুলতে পারছে না মানুষটাকে। ক্রমশঃ অস্বস্তি বাড়তে থাকে তার। এই ভাবে হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকা তার স্বভাব বিরুদ্ধ। কিন্তু মধ্যজীবন পেরিয়ে গেলো মানুষের লজ্জা, ঘৃণা আর ভয়ের অনুভূতিগুলো বোধহয় এইরকম নিম্নগামী হয়। আজ সেটা বিশেষভাবে অনুভব করলেন তিনি।
তৃতীয় কাপ চা দেবার সময় ধাবার ছেলেটাও একটু বিশেষভাবে তাকিয়ে চলে গেলো। ভাবখানা দেখে মনে হলো, বলতে চাইছে ” এ বুড়োর আজ হোলো কি !”
ছেলেটার নাম দিলু। কিন্তু সুপ্রকাশ কোনোদিন নাম ধরে ডাকেননি। প্রত্যেকবার চা খাওয়া হয়ে গেলে ইশারায় হাত তুলে ছেলেটাকে ডাকেন , ওর হাতে টাকা দেন। একটু পরে ছেলেটা ফেরত আসে। আর একটা প্লেটে করে তার ফেরত পয়সা সামনে রাখে। তিনি সব টাকা তুলে নিয়ে দুটাকা রেখে দেন প্লেটে। ঠিক এই ঘটনাক্রমই চলে আসছে প্রায় বছর খানেক ধরে।
আজ কি মনে হলো, ছেলেটাকে নাম ধরে ডাকলেন তিনি। ছেলেটা তখন সবে ফেরত পয়সা সামনে এনে রেখেছে।
-“তোর নাম দিলু তো ?”
– হ্যাঁ কাকু ।
– আচ্ছা, ওই ভেতরের দিকে কোনায় যে লোকটা বসে খাচ্ছে , ওই লোকটাকে তুই চিনিস?
দিলু একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বললো – এক নম্বরে যে বসে ? ওই দাড়িওয়ালা লোকটা ?
– হ্যাঁ , তুই চিনিস ? এখানে প্রায়ই আসে ?
– না স্যার আগে দেখিনি। তবে কাছ থেকে দেখলে আপনার ভয় করবে । কেমন একটা অদ্ভুত চাউনি। তার ওপর বারোটা আঙ্গুল।
নিজের অজান্তেই খানিকটা চমকে উঠলেন সুপ্রকাশ। কোথাও যেন সূত্রটা একটু জোড়া লাগলো। কিন্তু তাতে ভিতরের অস্থিরতা একটুও কমলো না। দিলু চলে গেলো , কিন্তু ওই বারোটা আঙুলের ব্যাপারটা ঘুরতে লাগলো মাথার মধ্যে। কিন্তু না, এবার উঠতে হবে। অনেকটা বেলা হয়ে গেলো। দুটাকার কয়েনটা টেবিলে রেখে উঠে পড়লেন।
বাইরের দিকে যেতে যেতে একটু দাঁড়িয়ে পড়লেন। নাঃ একবার কাছ থেকে লোকটাকে দেখতেই হবে। নিজের মনটাকে গুছিয়ে নিয়ে ধাবার ভিতরের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলেন তিনি । লোকটা যেখানে বসে তার উল্টোদিকের টেবিল থেকে এক হাতে প্লাস্টিকের জলের জগটা তুলে নিলেন। মাছের ব্যাগটা নামিয়ে রাখলেন পায়ের কাছে। এখানকার জল খাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই , কিন্তু ভানটা করে যেতে হবে।
হঠাৎ কোথা থেকে দিলু এসে উপস্থিত। ” স্যার , জল খাবেন , গ্লাস দেবো ?” বলেই চোখের ইশারায় লোকটাকে দেখাতে লাগলো। ওফ , ছোঁড়াটা জ্বালালো দেখছি!
– না না , গ্লাস লাগবে না , তুই যা।
বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন লোকটার দিকে। একমনে মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাছ থেকে দেখেও খুব একটা সুবিধে হচ্ছে না। একেতে দাড়িগোঁফের জঙ্গল , তার উপর মাথা নিচু করে থাকা। নাঃ , এবার যেতেই হবে। একদম সোজা বেরিয়ে না গিয়ে, একটু কায়দা করে লোকটার একদম কাছ থেকে ঘুরে গেলেন সুপ্রকাশ।
লোকটার কাছ বরাবর ঘুরতেই পিছন থেকে শুনতে পেলেন একটা ডাক – শুঁয়োপোকাস।
চমকে উঠলেন তিনি। মনে হলো বহু যুগের ওপর থেকে কে যেন ডাকলো তাকে । কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পিছনের দিকে ঘুরলেন তিনি। মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো – দিগ্রেট !!
– যাক চিনতে পেরেছিস তবে। আমি কিন্তু তোকে একবার দেখেই চিনেছি।
– চিনবিনা কেন ? আমারতো আর তোর মতো একমুখ জঙ্গল নেই।
– তা ঠিক। এখনো চেহারাটাকে ঠিক ধরে রেখেছিস। চকচকে গাল। ঝকঝকে হাসি।
– রাখতে হয় জানতে হয় ভাই। এখনো শরীর চর্চা করি।
– তোদের দেখে ভালো লাগে। দাঁড়িয়ে কেন বোস। অবশ্য মাছ কিনেছিস দেখছি। বেলা বাড়লে আবার মাছ খারাপ না হয়ে যায়।
– বেলা বাড়লে মাছ খারাপ হবে না তার গ্যারান্টী দিতে পারি, কিন্তু আমার গিন্নির মেজাজ খারাপ হবে কিনা তার গ্যারান্টী দিতে পারবোনা।
হেসে ওঠে দুজনে একসাথে। সুপ্রকাশ বসে পড়ে উল্টোদিকের বেঞ্চে। পায়ের কাছে টেনে নেয় মাছের ব্যাগটা। মন্দিরাকে ফোন করে।
– শোনো, আজ আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। আমার এক ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো হঠাৎ। না না , খুব বেশি দেরি হবে না – মাছে বরফ দেওয়া আছে , চিন্তা নেই। রাখছি।
এতক্ষণে ভালো করে দেখে তাকিয়ে দেখে তার বন্ধুকে – “দিগ্রেট” – আলেকজান্ডার দি গ্রেট।
আসল নাম আলোক জোয়ারদার। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, ক্লাস এইট এ বছরের মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন ওদের ক্লাসে উদয় হলো ও। সুপ্রকাশ ও তার বন্ধুরা ভাবছিলো এই নতুন ছেলেটাকে একটু বাজিয়ে নেবে। কিন্তু প্রথমদিন টিফিনের আগেই ওরা বুঝে গেলো, এ ছেলে ওদের সবার বাজনা বাজিয়ে দেবে। অঙ্ক, বিজ্ঞান , সাহিত্য সব বিষয়েই সে খুব ভালো। সব প্রশ্নের পটাপট উত্তর দিচ্ছে। কোনোরকম জড়তা নেই। দেখে বোঝাই যাবে না যে এটা স্কুলে তার প্রথম দিন।
টিফিনের সময়টা সবাই ব্যস্ত থাকে কোনোমতে কিছু খেয়ে কি করে তাড়াতাড়ি খেলতে যাবে। কিন্তু সেদিন কেউ গেলো না খেলতে। সবার নজর আলোকের দিকে। সবের চোখেই একটা সম্ভ্রমের দৃষ্টি।
ফার্স্টবয় বোধিসত্ত্ব গেলো সবার আগে আলাপ জমাতে।
– তোমার নাম অলক ? আমি বোধিসত্ত্ব।
সুনন্দকে আমরা সবাই জানি বোধিসত্ত্ব -র চ্যালা বলে। সে পাশ থেকে বলে উঠলো – আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ও।
সে কথায় পাত্তা না দিয়ে, বোধিসত্ত্বর হাতটা ধরে সাহেবী কায়দায় ঝাঁকিয়ে বললো –
– নাইস মিটিং ইউ বোধি। তবে আমার নাম অলক নয়, আলোক। আলোক জোয়ারদার। ভালো করে লক্ষ্য করলে বুঝবি ওটা আসলে “আলেকজান্ডার” – আ-লে-ক-জা-ন-ডা-র – ইতিহাসের পাতা থেকে সোজা উঠে আসা “আলেকজান্ডার দি গ্রেট। ” আমার আগের স্কুলে সবাই আমাকে “দিগ্রেট” বলেই ডাকতো। তোরাও আমাকে ওই বলেই ডাকবি।
কোনো দ্বিধা নাই, কোনো জড়তা নেই , এমনকি আত্মপ্রচারের ভঙ্গিমাটাও একেবারে অনন্য। কয়েকদিনের মধ্যে ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সবার কাছেই ছড়িয়ে পড়লো “দিগ্রেট” এর মহিমা। অনেকেই “আলোক জোয়ারদার” কি বিশেষ ভঙ্গিতে উচ্চারণ করলে “আলেকজান্ডার” হয়ে ওঠে তার ব্যাখ্যা করতে লাগলো।
ওর আরো একটা জিনিস বিশেষ দ্রষ্টব্য । প্রথমদিনই টিফিনের সময় ক্লাসের সকলের সামনে, বেঞ্চের উপরের ওর দুহাতের আঙ্গুলগুলো মেলে ধরে বললো – এই দ্যাখ , আমার বারোটা আঙ্গুল। আলেকজান্ডারেরও ছিল। ওসব কথাতো আর আমাদের ইতিহাস বইতে লেখা থাকেনা, গ্রিক ঐতিহাসিক এর লেখা পড়লে জানতে পারবি। বারোটা আঙুলের অনেক সুবিধা। তোরা যেটা সহজে ধরতে পারবিনা আমি সেটা অনায়াসেই পারবো। যেমন ধর, তরবারী। সাধে কি আমি নিজেকে আলেকজান্ডার বলি ! তবে শুধু কিন্তু তরবারির শক্তি নয়, মস্তিষ্কের শক্তিও আছে । জানিসতো, মানুষের ব্রেন এর ভিতর ইলেকট্রিক ওয়ারিং এর মতো অনেক তারের জাল থাকে। আমাদের মতো যাদের বারোটা আঙ্গুল তাদের ওই ওয়ারিং টা খুব স্ট্রং হয়। আমাকে দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস সে কথা।
বলার ভঙ্গিতে এতটা আত্মবিশ্বাস যে তাতে প্রশ্ন তোলার বা সন্দেহ করার কথা কারুরই মনে হতো না। সন্দীপ টা বরাবরই একটু ফচকে। পিছন থেকে সুর টেনে বলে উঠলো – ভাইরে, কত কিছু জানার আছে জীবনে !
স্কুলে নিচের ক্লাসের ছেলেরা সবসময় উঁচু ক্লাসের ছেলেদের দাদা বলে ডাকতো। সেই রীতি মেনে কয়েকজন অতি উৎসাহী ছেলে ওকে “দিগ্রেট” -দা বলে সম্মোধন করতে আরম্ভ করেছিলো , কিন্তু “দিগ্রেট” রীতিমতো ধমক দিয়ে ওদের বুঝিয়ে ছিল যে মহান ব্যক্তিরা কখনো কারুর দাদা-কাকা-মামা হয়না। যেমন “বিবেকানন্দ-দা ” , ” নেতাজি-দা ” হয় না , তেমনি “দিগ্রেট”-দাও হয় না। অতঃপর গোটা স্কুলে ওর একটাই পরিচয় – দিগ্রেট।
দিন কয়েকের মধ্যে ক্লাসে আমাদেরও সবার একটা করে নতুন নাম হলো। সবকটাই দিগ্রেট এর অতুলনীয় মস্তিস্ক সৃষ্ট। চলতে ফিরতে সে নামকরণ করে। যেমন প্রথমদিন-ই বোধিসত্বকে বলেছিলো –
-আমাদের বাবা-মা অনেক আশা করে আমাদের নাম দেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেটা কানাছেলের নাম পদ্মলোচন হয়ে যায়। হয় চেহারায় মানানসই হয়না , নয়তো আচার ব্যবহারে বেমানান হয়। এইযে তুই – তোকে দেখলে, না মনেহয় বোধিসত্ত্ব না আমসত্ব, তার চেয়ে তোর নাম যদি হয় বোঁদে, সেটা যেমন উপযুক্ত , তেমনি ডাকার-ও সুবিধে।
বোধিসত্ত্বের চেহারা বা ব্যবহারের কোন বৈশিষ্ট্যের সাথে বোঁদে-রূপ মিষ্টান্ন -এর মিল সেটা ক্লাসের কারুর বিন্দুমাত্র বোধগম্য হলো না। কিন্তু স্বয়ং ফার্স্ট বয় যদি নিজে তার এই নতুন নামে রাজি হয়ে যায়, তাদেরতো বলার কিছুইথাকে না। অতএব ক্লাস এইট এর ফার্স্টবয় বোধিসত্ত্ব হয়ে গেলো বোঁদে।
অবশ্য এতো দ্রুত ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের নামের এই ব্যবচ্ছেদে ক্লাসের বাকিরা একটু আতংকিত হয়ে পড়লো। ” বাংলার ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা ” দেখতে পেলো অনেকেই। কিন্তু দিগ্রেট -এর মধ্য একটা অসম্ভব আকর্ষণীয় ক্ষমতা ছিল। তাই তার থেকে কিছুতেই দূরে থাকা যেতো না।
বয়ঃসন্ধিতে ক্লাসে অনেকেরই তখন গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। ছেলের দলের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্কতার সেই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে একটা গর্ববোধ কাজ করতো। এদের মধ্যে সুপ্রকাশের গোঁফের রেখা ছিল বেশ স্পষ্ট। অনেকটা তা দেবার ভঙ্গিতে মাঝে মাঝেই সে হাত বোলাতো তার নবীন গোঁফ জোড়াতে। ব্যাপারটা দিগ্রেট এর নজরে পড়লো অচিরেই। একদিন ছুটির পর সুপ্রকাশকে ধরলো সে।
– তোর গোঁফটা কিন্তু বেশ আকর্ষণীয় – প্রজাপতি হবার সম্ভবনা আছে। জানিসতো সারা পৃথিবীতে কতরকম গোঁফের ধরণ হয়? বাটারফ্লাই মাসতাস, পেন্সিল মাসতাস, হর্স শু মাসতাস, ফু মাঞ্চু মাসতাস – আরো কত কি!
ততক্ষনে আশপাশে বাকি ছেলেরা এসে জুটেছে । গোঁফদাড়ির ইতিহাস, ভূগোল ও বিজ্ঞান জানতে। একটা দেঁতো হাসি দিয়ে দিগ্রেট বললো –
– তবে ওই যে বললাম, তোর গোঁফ জোড়ার প্রজাপতি হবার সম্ভবনা আছে, সেটা কিন্তু এমনি এমনি না। ভালো করে তাকালেই বুঝবি, ওটা এখন একটা আস্ত শুঁয়োপোকা। আমি ভাবছি, আজ থেকে তোকে সুপ্রকাশ না বলে শুঁয়োপোকাস বলবো। কি রে তোরা কি বলিস ?
আশপাশের সবাই তখন বিপুল হর্ষধ্বনিতে এই নতুন নামকে স্বাগত জানালো। সুপ্রকাশ নামটা থেকে গেলো শুধু স্কুলের খাতায়।
এতদিন পরে, শুঁয়োপোকাস নামটা শুনে এক ঝটকায় সব কিছু মনে পড়ে গেলো সুপ্রকাশের।
– তোকে দেখে যে কি ভালো লাগছে দিগ্রেট। স্কুলের সেদিনগুলোর মতো দিন আর কোনদিন হলো না। গোল্ডেন ডেস। কিন্তু তুই হঠাৎ কোথায় উধাও হয়ে গেলো বলতো ? অ্যানুয়াল পরীক্ষার মাঝে সেই যে স্কুলে আসা বন্ধ করলি, আর কোনোদিন এলি না। তোর কত খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছি আমরা।
– বাবা মারা গেলো – অনেকটা দেনা রেখে গেছিলো । মা-তো আগেই পাগল ছিলো। বাবা চলে যাবার পর পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গেলো। হাসপাতালে দিতে হলো। পাওনাদারেরা সব দখল করে নিলো। আমি আর বোন আশ্রয় পেলাম এক কাকার কাছে। কিন্তু সেখানেও ……যাগ্গে ছাড় আমার কথা। তুই নিশ্চয়ই অনেক পড়াশুনা করে অনেক বড়ো চাকরি করেছিস।
– হ্যাঁ আমরাও এখানকার পাট একপ্রকার তুলে দিয়েছিলাম। বাবার এখান থেকে কলকাতার ব্যবসা দেখার অসুবিধে হচ্ছিলো , আর আমিও যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ঢুকলাম। তাই বাবা বালিগঞ্জে একটা বাড়ি কিনলেন , আর আমরাও সেখানে চলে গেলাম। ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে চাকরি পেলাম ম্যাকান্সি তে। তারপর তেঁতাল্লিশ বছর চাকরি ঐ একই কোম্পানিতে। তিন বছর হলো রিটায়ার করেছি। আমার দুই ছেলে। বড়জন পিএইচডি করছে অক্সফোর্ডে , আর ছোটোজন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটে বি স্ট্যাট করছে। তাই কর্তা -গিন্নি আবার ফিরে এলাম এখানে।
– বাহ্ খুব ভালো। একেবারে পরিপূর্ণ সুন্দর জীবন। আমি এখানে অনেকদিন পর এলাম। তা স্কুলের কারুর সাথে যোগাযোগ আছে? বোধিসত্ত্ব, দীপক, সৌম্য, দিব্যেন্দু , ময়ূখ –
– তোর হলো কি ? তোর দেওয়া সব নাম , এখন তুই-ই ভুলে গেলি ! আমরাতো আর কোনোদিন কাউকে আসল নামে ডাকতেই পারি নি।
– ওসব ছেলেমানুষি – এখন মনে পড়লে হাসি-ই পায়।
– বোঁদে যদ্দুর শুনেছি আমেরিকায় সেট্লড। পোকার (দীপক) সাথে বহুদিন আগে একবার দেখা হয়েছিলো , তখন ও বোম্বে ছিল কি একটা ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি তে। বাকিদের মধ্যে, একমাত্র ঢিপি ( ডিপি – দিব্যেন্দু পোদ্দার) এখনো এখনই থাকে জানি – ওর পোল্ট্রির ব্যবসা।
দুই বন্ধু আরো কিছুক্ষণ মগ্ন থাকে পুরোনো দিনের স্মৃতি চারণে। সহপাঠীদের কথা, শিক্ষকদের কথা, খেলার মাঠের কথা – হরেক বদমাইশি আর শাস্তির কথা। সুপ্রকাশ লক্ষ্য করে , দিগ্রেট কিছুতেই তার নিজের কথা বলতে চাইছে না। সুপ্রকাশ ও তাই সচেতনভাবে সে দিকটা এড়িয়ে চললো। হঠাৎ -ই বেশ জোরে হেসে ওঠে সুপ্রকাশ।
– তোর বাংলা স্যার এর কথা মনে আছে ? বিভূতিবাবু – তুই নাম দিয়েছিলি বিভঙ্গ স্যার। আর সেই মধ্যপদলোপী কর্মধারায় ? কি কান্ডটাই না তুই করেছিলি !
সেটা ছিলো দিগ্রেট-এর আর একটা পাগলামো, যখন যে বিষয়টা মাথায় চাপবে সেটা নিয়েই মাতবে বেশ কতদিন। উঠতে বসতে তার প্রয়োগ। শুধু নিজে বুঝবে না, সকলকে বুঝিয়ে ছাড়বে। সেবার যখন সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক ক্লাসে নতুন শেখানো হলো , ক্লাসের অনেকেই দেখা গেলো কিছুতেই বুঝছে না। জ্যান্ত (জয়ন্ত ) স্যার ক্লাসে রীতিমতো চেঁচামেচি করলেন। সেই সমস্ত পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের বোঝানোর গুরুদায়িত্ব নিল দিগ্রেট। স্কুলের সিঁড়ির ধাপে ধাপে রীতিমতো চক দিয়ে ছক কেটে ছাত্রদের দাঁড় করালো এক একটা জায়গাতে। কেউ কেউ হলো সংখ্যা , কেউ কেউ হলো অপারেটর , মানে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ চিহ্ন। ঘন্টা খানেক ধরে চললো সেই মহাযজ্ঞ। গোটা স্কুল বুঝলো, কাকে বলে সিঁড়ি ভাঙা অঙ্ক !
তেমনি আর একটা বিষয় মধ্যপদলোপী কর্মধারায়। তখন ক্লাসে সমাস পড়ানো চলছে। পড়াচ্ছেন বিভঙ্গ স্যার। এই বিভঙ্গ স্যারের সাথে আবার দিগ্রেট-এর ছিল আদায়-কাচঁকলায় সম্পর্ক। গোটা স্কুলে একমাত্র বিভঙ্গ স্যার-ই ওকে “আলোক” বলে ডাকতেন। তাতে ও ভয়ানক চটে যেত। সেই কারণে ক্লাসে যখন তখন উটপটাং প্রশ্ন করতো।
সেদিন বিভঙ্গ স্যার ব্যাখ্যা করেছেন কর্মধারায় সমাস। কয়েকটা উদাহরণ ও দিয়েছেন। অনেকটা ডিক্টেসন দেবার ভঙ্গিতে চোখ বুঁজে দুলে দুলে একই বাক্য বারবার বলেন উনি। মাঝে মাঝে আবার থেমে যান, একটু ঝিমিয়ে নেন, তারপর আবার জেগে উঠে পড়াতে আরম্ভ করেন।
স্যার বলে চলেছেন – তাহলে কর্মধারায় সমাস কি ? যে সমাসের পরপদ বা উত্তরপদের প্রাধান্য থাকে এবং তা কোনোকিছুর তুলনা বোঝায় তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। আর মধ্যপদলোপী কর্মধারায় কি ? যেখানে মধ্যের পদ লোপ পায়। যেমন – সিংহাসন – সিংহ চিহ্নিত আসন , পলান্ন – পল মিশ্রিত অন্ন ……………..।
ওদিকে বিভঙ্গ স্যার চোখ বুঁজে একই কথা বলে চলেছেন , আর অন্য দিকে গোটা ক্লাস ব্যস্ত। কেউ কাগজের এরোপ্লেন বানিয়ে ছুঁড়ছে অন্যের দিকে, একদল কাটাকুটি খেলছে, একদল বুক ক্রিকেট – মানে গোটা ক্লাস জুড়ে তখন চলছে বিচিত্র খেলার আসর। পড়াতে পড়াতে কখন ঘাড় গুঁজে ঘুমিয়ে পড়লেন বিভঙ্গ স্যার ।
হঠাৎ দিগ্রেট দাঁড়িয়ে উঠে সচকিতে ডাকলো – স্যার।
বিভঙ্গ স্যার ধড়মড়িয়ে উঠে সামনে দিগ্রেট কে দেখে খেঁকিয়ে উঠলেন – কি হয়েছে ? চেঁচাচ্ছিস কেন রে আলোক ?
একেবারে নিরীহ ভিজে গলা করে দিগ্রেট বললো – চেঁচাই নিতো স্যার। আসলে আপনিতো চোখ বুঁজে ভাবছিলেন , তাই আপনার ওরকম মনে হচ্ছে স্যার। গভীরভাবে চিন্তা করলে ওরকম মনে হয় স্যার।
– থাক তোকে আর ডেপোমি করতে হবে না। ডাকছিলি কেন?
– আচ্ছা স্যার, ঢিপি-ফোঁড়া – ঢিপির ওপর ফোঁড়া , এটা কি মধ্যপদলোপী কর্মধারায় ?
– ঢিপি-ফোঁড়া! সেটা আবার কি ?
– আজ্ঞে স্যার, ওই কথায় যে বলে না ” গোদের উপর বিষ ফোঁড়া”, আমাদের দেশের বাড়ির গ্রামে ওটাকেই বলে ঢিপি-ফোঁড়া। ওখানকার লোকেদের খুব হয় স্যার।
মুহূর্তের মধ্যে ক্লাস জুড়ে উঠলো হাসির ফোয়ারা। সে হাসি থামতেই চায়না। অচিরেই দিগ্রেটকে ক্লাসের বাইরে বার করে দিলেন বিভঙ্গ স্যার। দিগ্রেটও নাচতে নাচতে চলে গেলো ক্লাসের বাইরে। বিকেলের মধ্যে গোটা স্কুলে ছড়িয়ে পড়লো দিগ্রেট এর এই নতুন কীর্তি।
এরপরের বেশ কিছুদিন চললো মধ্যপদলোপী কর্মধারায় এর প্রয়োগ। যখন তখন যেখানে সেখানে শব্দ নিয়ে জাগলিং।
বোধিসত্ত্বর জন্মদিনে প্রতিবছর ক্লাসের সকলের নেমন্তন্ন থাকে। ওরা এ অঞ্চলের খুব অবস্থাপন্ন পরিবার – একসময় জমিদার ছিল। সারা বছর সবাই তাকিয়ে থাকে ওই দিনটার জন্য। অনেকরকম খেলাধুলো, ম্যাজিক শো, আর সব থেকে বড় আকর্ষণ ভুঁড়িভোজ । রীতিরেয়াজ মেনে সকাল দশটায় বোধিসত্ত্বকে ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্ব্বাদ করেন বড়োরা। একটা বড় কাঁসার পাত্রে সাজিয়ে নানারকম মিষ্টি দেওয়া হয়। অনুষ্ঠান শেষে বোধিসত্ত্ব নিজের হাতে তার বন্ধুদের মিষ্টি বিতরণ করে।
সেদিনও তেমনি নিয়মেই সব চলছিলো। আশীর্ব্বাদ পর্ব চলছে। দীপক ছিল সুপ্রকাশের পাশেই দাঁড়িয়ে। সে হঠাৎ সুপ্রকাশকে কনুই দিয়ে ধাক্কা মেরে ফিসফিস করে বললো ” দিগ্রেট কে দ্যাখ, কিরকম হ্যংলার মতো তাকিয়ে আছে। ” সুপ্রকাশ তাকিয়ে দেখলো যে কথাটা কতটা সত্যি। এ চাউনি তাদের খুব চেনা। দিগ্রেট মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে। তার ওপর ও যেন মিষ্টির গন্ধ পায়। ক্লাসের কেউ টিফিনে মিষ্টি আনলে ওরে দৃষ্টি ও ঘ্রাণ এড়ানো কঠিন। সেই ওর সামনে থরেথরে মিষ্টি সাজানো , অথচ ও খেতে পাচ্ছে না। একেবারে নাজেহাল অবস্থা।
ইতিমধ্যে আশীর্ব্বাদ পর্ব শেষ। বাড়ির বড়োরা আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ ভিড় ঠেলে একবারে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো দিগ্রেট। একেবারে সোজা গিয়ে বোধিসত্ত্বর সামনে হাঁটুমুড়ে বসে পড়লো। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলতে লাগলো –
– তোর পাতে এতরকম মিষ্টান্ন পদ দেখে আমার বাংলা ব্যাকরণের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে রে বোঁদে। এ যেন একেবারে কর্মধারয় সমাস। যদিও এখানে পূর্ব বা উত্তর পদ খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল, কেননা এই মিষ্টিগুলো দেখ কেমন বৃত্তাকারে সাজানো। তবে পূর্ব বা উত্তর পদ না পাওয়া গেলেও মধ্যপদ কিন্তু আছে – এই যে এই বাটিতে – এই যে রাজভোগ।
আঙ্গুল দিয়ে থালার মধ্যিখানে রাখা রাজভোগটাকে দেখায়।
– তাহলে এই হলো মধ্যপদ , আর এই দ্যাখ কাকে বলে মধ্যপদলোপী –
কথা বলতে বলতেই বাটি থেকে রাজভোগটা তুলে এত্ত বড় একটা হা করে সটান মুখে পুরে দিলো দিগ্রেট। সকলে একেবারে স্তম্ভিত। কারুর মুখে বাক্যি নেই। সে দৃশ্য ভোলাবার নয়। খুব ধীরে ধীরে মুখ নাড়িয়ে চোখ দুটো অর্ধনিমীলিত করে রাজভোগ এর প্রতিবিন্দু রস তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে একজন। আর একঘর ছেলে দর্শক হয়ে তার সেই পরিতৃপ্তির প্রতিটা ক্ষণ অনুভব করছে।
রাজভোগ শেষ করে পূর্ণচক্ষু মেলতেই সে দেখলো বোধিসত্ত্বর সহাস্য মুখ – কি রে আর খাবি ?
– নাঃ , আমি বেশি খাইনা – জলের গ্লাসটা বরং দে।
এই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সে যাত্রায় দিগ্রেট -এর সমাস পর্ব শেষ হলো। আবারো সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো এই ঘটনা। দেখা গেলো, স্কুলের টিফিনের সময়, যখন তখন এ ওর টিফিন বাক্স থেকে ছোঁ মেরে খাবার তুলে নিয়ে বলছে – এই দ্যাখ, একে বলে মধ্যপদলোপী।
কতদিন আগের কথা , কিন্তু সুপ্রকাশের কাছে যেন চলচ্ছবির ভেসে উঠলো সব। হো হো করে হাসছে সে আর বলছে – তোর এইসব গল্প আমি যে কত লোককে কতবার বলেছি, কি বলবো ! সবাই শুনে শুধু একটাই কথা বলেছে – আমার বন্ধু যে “দি গ্রেট” সে বিষয় কোনো সন্দেহ নেই।
একটা শুকনো হাসি ফুটে উঠে দিগ্রেট-এর মুখে। টেবিলের উপর রাখা প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে ধরায়। তারপর ধীরে ধীরে বলে –
– মনে হচ্ছে তুই যার কথা বলছিস সে লোকটা আমি নই। কিন্তু একটু আগেই যখন তোকে “শুঁয়োপোকাস” বলে ডাকলাম , তখন বোধহয় কিছুক্ষনের জন্য আমি তোদের দিগ্রেট হয়ে গেছিলাম রে ।
কথা বলার মাঝে একটা অল্পবয়সী ছেলে দিগ্রেট-এর পাশে এসে দাঁড়ায়।
– মামা তোমার কি দেরি হবে ?
– নানা , দেরি হবে না , তুই বাইরে বোস , আমি ডেকে নেবো।
ছেলেটা চলে যায়। সেইসময় সুপ্রকাশের পকেটের ভিতরে রাখা ফোনটা বেজে ওঠে। নিশ্চয়ই মন্দিরা। ফোনটা ধরে নেয় সে – হ্যাঁ , এবার উঠছি…….. দশ মিনিটে পৌছাবো….. হ্যাঁ রিকশা নিয়ে নেবো ……..কচুরি ? আচ্ছা ….হ্যাঁ হ্যাঁ ভুল হবে না …. রাখছি।
ফোনটা নামিয়ে রেখে একটু ব্যস্ত হয়ে ওঠে সুপ্রকাশ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে ডাক দেয় দিলুকে। ডাক শুনে সটান হাজির দিলু।
– শোন ছটা কচুরি প্যাক করে দেতো চটপট। আর এই নে টাকা।
– হ্যাঁ স্যার একদম গরম গরম ভাজছে। এই গেলাম আর এলাম।
টাকা নিয়ে চলে যায় দিলু।
– এবার উঠি রে দিগ্রেট, অনেক বেলা হয়ে গেলো। একদিন বাড়ি আয় না – যুবসংঘ ক্লাবের পাশেই আমার বাড়ি – যে কেউ চিনিয়ে দেবে। আচ্ছা দাঁড়া আমার এড্র্রেস আর ফোন নাম্বারটা তোকে লিখে দি।
পকেটে সবসময় পেন থাকে সুপ্রকাশের কাছে – বহুদিনের অভ্যেস। পকেট থেকে একটা ভিসিটিং কার্ড বার করে তার উপর লিখতে থাকে।
– আমার অফিসিয়াল কার্ড ছিল এটা, এখনতো রিটায়ার্ড , তাই এগুলোর এই ভাবেই সদ্ব্যবহার করি। এটার পিছনে লিখে দিলাম।
আর তোর ফোন নম্বরটা বরং আমাকে দে।
বলতে বলতে দিগ্রেট-এর দিকে কার্ডটা এগিয়ে দেয় সুপ্রকাশ। হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলেও , সুপ্রকাশের মনে হলো ওর খুব একটা উৎসাহ নেই নিতে।
– আমারতো ফোন নেই ভাই। আসলে আমাকে ফোন করারতো লোক নেই, তাই ফোনও নেই ।
সুপ্রকাশ আর কথা বাড়ালো না। মনে হচ্ছে , ও ফোন নম্বর দিতে চাইছে না। হাতে বাজারের থলিটা বাঁহাতে তুলে ডানহাতটা করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দেয় দিগ্রেট-এর দিকে ।
– ঠিক আছে, তাহলেতো তুই আমার বাড়ি না আসলে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই।
– আমার ডানহাতটা এখনো এঁটো রে।
এই বলে বাঁহাত দিয়ে আলতো করে সুপ্রকাশের হাতটা ছুঁলো দিগ্রেট।
সুপ্রকাশ আস্তে আস্তে দিগ্রেট-এর পাশ দিয়ে এগিয়ে যায় বেরোনোর পথে। দিগ্রেট চোখ দুটো নামিয়ে একই ভাবে বসে থাকে। এই শেষটা ভালো লাগলো না সুপ্রকাশ এর। ফোন নম্বর দিলো না , হাত মেলালো না। এমনকি বেরোনোর সময় বাইরে পর্যন্ত একটু হেঁটে সঙ্গে যাওয়া দূরাস্ত , উঠে দাঁড়ালো পর্যন্ত না ! এতো টুকু সৌজন্য বোধ পর্যন্ত নেই ! কিসের এতো দম্ভ ওর ? কিসের এতো অহংকার ? যোগাযোগ রাখার গরজটা শুধু আমার ? ভিতর ভেতর একটা রাগ জমতে থাকে সুপ্রকাশের। একবারও পিছনের দিকে না তাকিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় গেটের দিকে।
গেটের কাছাকাছি আসতেই দেখলো , সেই ছেলেটা যে দিগ্রেটকে মামা বলে ডেকেছিলো । বাইরে একটা ভ্যানরিকশার সামনে দাঁড়িয়ে।
ধাবার গেটের পাশেই রিক্সাস্ট্যান্ড। সুপ্রকাশকে রিক্সাচালকেরা সবাই চেনে। একজন ডাক দেয়।
– আসুন বড়দা , এইটা যাবে।
রিক্সায় উঠে বসে সুপ্রকাশ। ভিতর ভিতর একটা অদ্ভূত রাগ জমতে থাকে। কোথাও যেন একটা অপমানিত বোধ হচ্ছে । এই একটু আগেই লোকটাকে চিনতে না পাড়ার অস্বস্তি , তারপর চিনতে পাড়ার আনন্দ আর উত্তেজনা , আর এই এখন অপমান আর হতাশ। এতগুলো আবেগের এতো দ্রুত পরিবর্তন অনেকদিন ওর জীবনে ঘটেনি। কিচ্ছু একটা ভীষণ ভাবে লুকাতে চেয়েছে দিগ্রেট। ওই ভ্যান রিক্সা করে কিছু কি মাল নিয়ে যাবে ? কিছু একটা ব্যবসা করছে হয়তো , যা সুপ্রকাশকে জানাতে চায় না। কত যে বিচিত্র মানুষ ! কিছুতো কম দেখলো না সে জীবনে।
রিক্সাটা একটু জোরে চলতেই একটা হালকা হাওয়া এসে লাগলো মুখে। ঘাড়ের ডান পাশটায় একটা ব্যথা অনুভব করলো সুপ্রকাশ। একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ে। নাঃ একটু রিলাক্সেড হতে হবে। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ আর ঘাড়ের ঘামটা মুছে নেন।
হঠাৎ খেয়াল হলো – এই যাহঃ কচুরিটাতো আনা হলো না। পয়সা নিয়ে গেলেও ছেলেটাতো কচুরিটা দিয়ে গেলো না। বেরোনোর সময় এতটা বিরক্ত ছিল সুপ্রকাশ যে কচুরির কথাটা মাথা থেকে উড়ে গেছিলো । এখন খালি হাতে ঢুকলে আর দেখতে হবে না। নাঃ ফিরতে হবে। ভাগ্যিস বেশিদূর যায়নি।
– এই যে ভাই , রিকশা ঘোরাও , ধাবায় ফেরত চলো।
– কেন বড়দা, কিছু ফেলে এলেন ?
– হ্যাঁ হ্যাঁ – তাড়াতাড়ি ঘোরাও।
রিকশা আবার ধাবার দিকে চলতে লাগলো। সুপ্রকাশ ঠিক করে নিলো সে ধাবার ভিতরে যাবে না , গেটের কাছ থেকে রিকশায় বসে ডাক দেবে দিলুকে। সে আর দিগ্রেট – এর মুখোমুখি হতে চায় না। একটা মানসিক প্রস্তুতি নিতে লাগলো সে। যদি দেখা হয়েও যায় , একটা শুকনো হাসি ছাড়া সে কিছু দেবে না।
গেটের কাছে রিকশাটা দাঁড়াতেই , একটু তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লো সুপ্রকাশ। কয়েকপা এগোতেই চমকে উঠলো। সেই ছেলেটা একেবারে পাঁজাকোলা করে দিগ্রেটকে এদিকেই নিয়ে আসছে। কি হয়েছে ওর ? অসুস্থ ? ভাবতে ভাবতেই দেখলো ছেলেটা দিগ্রেটকে কোল থেকে নামিয়ে সামনের ভ্যান রিকশায় রাখলো। সমস্ত দেহ দিয়ে শিহরণ বয়ে গেলো তার। এক নিমেষেই ঘেমে গেলো আপাদমস্তক। যা দেখছে তা কি সত্যি ! দিগ্রেট এর দুটো পা কাটা !
একপা দুপা করে একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। হঠাৎ চোখাচোখি হলো দিগ্রেট এর সঙ্গে। ওর দিকে মুখ তুলে দিগ্রেট বললো –– কি রে তুই – এখনো বাড়ি যাস নি ?
– তোর কি – মানে কবে – কোথায় ? তুই একবারও আমাকে জানতে দিলি না ?
– কি জানাবো তোকে ? তুই কতদিন পরে তোদের দিগ্রেটকে পেয়ে এতো খুশি , সেখানে আমার এই ক্ষুদ্র দুঃখের কথা বলে রসভঙ্গ করবো ?
– ক্ষুদ্র দুঃখ , কি বলছিস ? আমিতো কিছুই – কি করে হলো এটা ? কতদিন ?
মাথা নিচু করে থাকে দিগ্রেট। কোনো কথা বলে না।পাশ থেকে হঠাৎ সেই ছেলেটা এগিয়ে আসে।
– পাঁচ বছর হয়ে গেলো। জিটি রোডে একটা ট্রাক চলে যায় মামার পায়ের ওপর দিয়ে । তারপর ছমাস হাসপাতালে যমেমানুষে লড়াই।
– আঃ কৃষ্ণ , তুই থাম।
– মামা কোনোদিন কাউকে এই ঘটনা বলতে চান না জানেন। আমিও বলি না। তবে আপনি মামার বন্ধুতো তাই। তবে আপনি চলে যাবার পর মামার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছিলো। অনেকক্ষণ বসে ছিলেন।
কথা বলে বলতে কাঁধে রাখা একটা চাদর বিছিয়ে দেয় দিগ্রেট এর কোলের ওপর।
সুপ্রকাশের হাত দুটো চেপে ধরে দিগ্রেট। চোখের কোন জল।
– ও আমার ভাগ্নে কৃষ্ণ । আমার জীবন রথের সারথী।
– তোকে আমি ভুল বুঝেছিলাম রে দিগ্রেট- আসলে আমি চলে যাবার সময় তুই যখন উঠলি না –
– বিশ্বাস কর, কারুর সাথে কয়েকপা চলতে আমারও খুব ইচ্ছা করে, কিন্তু আমি যে পারিনি – বাবা, মা, বোন – যার সাথে দুপা চলেছি সে আমাকে ছেড়ে গেছে। আর এখনতো চলার উপায়টাই নেই।
সামনের থেকে ভ্যানওয়ালা বলে ওঠে – – বাবুরা একটু তাড়াতাড়ি করবেন , আমার আবার আর একটা ভাড়া আছে সেই দক্ষিণ পাড়ায়।
– হ্যাঁ হ্যাঁ চলো। আসি রে সুপ্রকাশ।
আর একটু শক্ত করে সুপ্রকাশ এর হাতটা চেপে ধরে দিগ্রেট।
– মৃত্যুশয্যায় বাবা আমার হাত দুটো ধরে বলেছিলো, আমি যেন জীবনের কোনো অবস্থায় ঈশ্বরে বিশ্বাস না হারাই। হারাইনি রে। কি জানি, হয়তো আমি এতো লোকের সাথে উপহাস করেছি, তাই উনি আমার সাথে এই উপহাস করলেন । তবু আমি বিশ্বাস হারাইনি রে। না ঈশ্বরে, না জীবনে। প্রতিদিন খুঁজে চলেছি পথ – বেঁচে থাকার জন্য। খুঁজছি জীবনের অর্থ।
একটু থামে দিগ্রেট। একটানা কথা বলতে গিয়ে হাঁফ লাগে তার। তবু থামতে পারে না। কাঁপা গলায় বলে – বিভঙ্গ স্যার একবার ক্লাসে একটা কবিতা বলেছিলেন। সেই যে, কোন এক কেরানির আকাশছোঁয়া উচ্চাকাঙ্খা – বিপ্লব আনবে সে। তার কথা বলতে গিয়ে কবি বলেছেন – -” চলন্ত রথের পানে চেয়ে খঞ্জের দূরান্ত অভিলাষ , ব্যর্থ হয় চূর্ণ হয় ………”
কথা বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে দিগ্রেটের।
– চলি রে। ভালো থাকিস। চলো ভাই ভ্যানওয়ালা।
সুপ্রকাশ দুপা পিছনে সরে আসে। ভ্যানটা আস্তে আস্তে পাশ দিয়ে এগিয়ে যায় সামনের পথের দিকে। পথের যতদূর দেখা যায় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সুপ্রকাশ। কানের মধ্যে শেষ কথাগুলো বাজছে এখনো – খুঁজে চলেছি পথ – বেঁচে থাকার জন্য – খুঁজছি জীবনের অর্থ – তবু বিশ্বাস হারাইনি।
একসময় পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যায় ভ্যানটা। দূরের সে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে সুপ্রকাশের – চোখের জলের কুয়াশায় সে দেখতে পায় এক অন্য জীবনযোদ্ধাকে – তার বন্ধু দিগ্রেট – যার জীবনের উত্তর-পূর্ব-মধ্য সব পথ রুদ্ধ করেছেন কোনো এক বিধাতা। নিষ্ঠুর, নির্দয় সেই বিধাতার দিকেই সে ছুঁড়ে দিচ্ছে চ্যালেঞ্জ – নির্মল পূজার ছলে – যার নাম বিশ্বাস। ভেঙে যাচ্ছে সমস্ত প্রতিরোধ – পদবিহীন এক জাগ্রত মানুষের আত্মবিশ্বাসের পদভারে কাঁপছে পৃথিবী। সৃষ্টি হচ্ছে এক অন্য পদাবলী। একেকটা পদাঘাতে বুঝিবা অবলুপ্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যপন্থার এক একটি স্তম্ভ – সুখ , নিরাপত্তা, স্বার্থপরতা – এ পদাবলী মধ্যপথলোপী।