কার্তিক স্যার

‘আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে’। কে দিল আমার চেতনার এত রং ? স্মৃতির সরণি বেয়ে যখন ফিরে দেখি ফেলে আসা সময়কে, তখন ভেসে ওঠে  অজস্র  মানুষের মুখ, যাদের স্পর্শে জন্ম নিয়েছে আমার চেতনার এত রং, যাদের সান্নিধ্যে  আমার  স্থবির চেতনা  হয়ে উঠেছে পরশপাথর। তাই তার স্পর্শে চুনি পান্না রঙিন হয়, পূবের আকাশে  জ্বলে ওঠে আলো । তেমনি এক মানুষ কার্তিক বাবু – কার্তিক স্যার । আমার প্রথম স্কুলের প্রথম হেডস্যার ।

আমার প্রথম স্কুল দেশবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয় । দমদম ক্যান্টনমেন্টে আমাদের বাড়ি থেকে তিন মিনিট হাঁটা পথ । দাদু (ঠাকুরদা)  একদিন হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন স্কুলে।  আমার খুব মজা, দাদার মতো আমিও যাব স্কুলে । মফস্বলের প্রাথমিক স্কুল – শুধু ছেলেদের জন্য । কোনমতে একটা দোতলা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। জরাজীর্ণ তার দশা । শিক্ষকদের  দশাও তথৈবচ । একটিমাত্র টিচার্স রুম। হেডস্যারসহ টিচার্সরা গাদাগাদি করে বসে থাকে ।  

অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় তাই স্কুলের ছাত্রদের অধিকাংশই স্থানীয়  মুটে মজুর রিক্সাওয়ালা মাছওয়ালা সবজিওয়ালা মিস্ত্রি এদের ঘরের । আমার মতো ‘ভদ্রলোক’ এর পরিবার  থেকে  হাতেগোনাই । সে বয়সের চোখে অবশ্য শ্রেণী বর্ণ অর্থ কোন বৈষম্যই ধরা পড়তো না । হয়তোবা সেটা সেই সময় এবং সেই প্রতিষ্ঠানের গুণও বটে । ওরা আমাকে বাকিদের  থেকে আলাদা চোখে দেখেনি,  তাই আমার চোখেও কেউ পড়িয়ে দেয় নি বিভাজনের কাজল । দেশবন্ধু স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা  আরেকদিন বলবো। আজ বলি কার্তিক স্যারের কথা ।

কার্তিক স্যার ছিলেন স্কুলের প্রাণপুরুষ। ৬ ফুট লম্বা, পেটানো চেহারা । এক মাথা ঝাঁকড়া কালো চুল । নিয়মিত শরীর চর্চা করতেন  ডাম্বেল বারবেল নিয়ে।  সাদা ধুতি আর সাদা  পাঞ্জাবির অনাড়ম্বর সাজ ছিল তার সদাসঙ্গী।   স্বামীজি শরীরচর্চার মাধ্যমে যুব সমাজ গঠনের যে ডাক দিয়েছিলেন, উনি ছিলেন সেই মন্ত্রে দীক্ষিত। 

 আগেই বলেছি ছাত্রদের সমাজগত অবস্থানের কথা। বলাই বাহুল্য, অধিকাংশ ছাত্রদের জামাকাপড়ের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয় ।  কার্তিক স্যারের একটা স্ট্যান্ডিং ইন্সট্রাকশন ছিল –  জামাকাপড় ছেঁড়া হলেও চলবে কিন্তু কিছুতেই নোংরা হওয়া চলবে না । আর খালি পায়ে স্কুলে আসা চলবে না । শুধু নির্দেশ দিয়ে উনি ক্ষান্ত  ছিলেন না , প্রতিদিন নজর রাখতেন  ছাত্রদের উপর । তিনি ছিলেন অকৃতদার ।তাই তার ছাত্র- অন্তপ্রাণ স্বভাবের খেসারত দিতে হতো গাঁটের কড়ি  খরচ করে । কারুর জুতো, কারুর জামা, কারুর বা খাতা পেন্সিল ।  যে  সামান্য  বেতন পেতেন তার অধিকাংশই ব্যয় হতো এই সমাজ কল্যাণে । তার এই দরদ কিন্তু ছিল ফল্গুধারার মতো প্রবহমান।  বাইরের মানুষটা ছিলেন রাগী এবং মেজাজী । 

 তখন স্কুল ছিল ক্লাস এইট পর্যন্ত ।  আর পাঁচটা শহুরে স্কুলের দুরন্ত বাচ্চাদের আপনারা যেমন দেখেছেন, আমার দেশবন্ধু স্কুলের ছাত্রদের সাথে তার কোন তুলনাই চলে না ।  ওদের   কার্যকলাপ ব্যাখ্যা করতে ‘দুরন্তপনা’ শব্দটা  নেহাতই ওজনহীন । ‘বাঁদরামো’ বললে আংশিকভাবে বোঝানো যায় । অধিকাংশই প্রকৃত অর্থে বন্য । সামাজিক অবস্থানের কথাটা  আরো একবার বোঝানো দরকার  কেননা,  আমাদের ভদ্রলোকের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে ওরা নিতান্তই ‘ছোটলোক’। জীবনের ন্যূনতম চাহিদার জন্য যে লড়াই তা ওরা  প্রত্যক্ষ করে  প্রতিদিন প্রতিনিয়ত । তাই আমাদের ভদ্র  ও পরিশীলিত  ‘ধমকানি ‘ তে সুড়সুড়ি লাগে ওদের কানে । ‘চিল-চিৎকার’ , ‘শাসানি’ এবং তার সাথে উত্তমমধ্যম ধোলাই ছাড়া  এদের  নিয়ন্ত্রণে  রাখা ছিল অসম্ভব । 

এদের মধ্যে উঁচু ক্লাসের কিছু ছাত্র ছিল মার্কামারা । বারকয়েক ফেল মেরে স্কুল থেকে বিতাড়িত হওয়ার অপেক্ষায় ।  এদের কার্যকলাপের একটা ছোট নমুনা দেওয়া যাক ।

 একদিন দুপুরে স্কুল চত্বরে কারুর একটি ছাগল হঠাৎ ঢুকে পড়ে । তখন অশোক স্যার ভূগোল পড়াচ্ছিলেন ক্লাস সেভেনে ।  দোতালার ক্লাসের জানলা থেকে নজরে আসে ভোলার । ফিসফিস করে সে জানায় শিবুকে । দিকভ্রষ্ট  অজ যদি ক্লাস শেষ হবার আগেই দিক খুঁজে পেয়ে স্কুলচত্বর  পরিত্যাগ করে !   অতএব  ক্লাস চলাকালীনই এর একটা গতি  করবার  আশু দরকার হয়ে পড়লো।  

ক্লাসরুমের দুর্বল জানলা শিবু-ভোলাদের  বহু অপরাধের সাক্ষী । জানালার শিক  তাই আগে থেকেই আলগা করা ছিল । ভোলা ওর বেতের মত শরীরটা অনায়াসে জানালা  গলিয়ে  বাইরে বার করে দিল।  তারপর  এক লাফে দোতলা থেকে  সোজা নিচে ।  

এর কিছুক্ষণ পর,  দু-একজন সেই ছাগলটির মৃদু আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল । বাকি আর কিছু জানা যায় না । শুধু জানা যায়, সেই রাতে শিবু ভোলা আর তাদের  সাঙ্গ-পাঙ্গদের  পিকনিক জমেছিল খুব। 

অতএব বুঝতেই পারছেন,  বাকি শিক্ষকদের কাছে একমাত্র অবলম্বন ছিল কার্তিক স্যার ।  ওই ভীমদর্শন চেহারার ছায়াকেও  ওই দামাল ছেলেরা ভয় পেতো  ।

  কার্তিক স্যারের শাস্তি দেওয়ার ভঙ্গিটাও ছিল একেবারে অন্যরকম   –  যাকে বলে ‘signature mark’ ।  কাউকে চড় গাট্টা কিংবা লাঠিসোটা দিয়ে কোনদিনই মারতেন না । শুধু মারতেন  কিল । তাও শুধু পিঠে । এই কিল প্রয়োগ হতো  অপরাধের মাত্রা বুঝে । মানে রোগের তীব্রতা বুঝে ‘dose’ ।  এই সমস্ত dose , প্রত্যেকটির আবার আলাদা আলাদা নাম ।  লঘু থেকে গুরু  মাত্রার ক্রমানুসারে  ‘গুমা’, ‘মধ্যগুমা’, ‘অতি গুমা’,  ‘ভীমা’, ‘মধ্য ভীমা’ – সর্বোপরি ‘মহিমা’ ।

 প্রতিবার প্রয়োগের আগে কার্তিক স্যার ঘোষণার ভঙ্গিতে জানাতেন এবার তিনি কি কিল প্রয়োগ করতে চলেছেন ।  গোটা স্কুলের সবাই জানতো কোন নামের কি মাহাত্ম্য   ।  কিন্তু শুধু কি  নাম মাহাত্ম্য ? ফল মাহাত্ম্য কিছু কম নয় ।  যাদের উপর এগুলো প্রয়োগ হত তারাই বুঝতো  এর আসল মাহাত্ম্য !

 প্রক্রিয়াটা মোটামুটি এইরকম ।  প্রথমে বাঁ হাত দিয়ে শাস্তি প্রাপকের মাথাটাকে ধরে নামিয়ে পিঠটা সম্পূর্ণ  উন্মুক্ত এবং সমান্তরাল  করা হতো।  এরপর অবনত গ্রহীতার প্রতীক্ষার পালা। নত অবস্থায় তাকে শুনতে হতো তার অপরাধের সবিস্তার বিবরণ । অবশেষে কার্তিক স্যার জানাতেন,  আজ গ্রহীতার জন্য কোন কিল ধার্য করা হয়েছে ।

 উপস্থিত দর্শককুল বাকনিরুদ্ধ  এবং  আতঙ্কিত । সকলের শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে যেন কিছু একটা বয়ে যেত অবিরাম । গ্রহীতা যদি দাগী  না হতো, তাহলে ততক্ষণে তার কাপড়-চোপড়ে  দশা ।  কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রহীতা হতো মার্কামারা পোড়খাওয়া বিচ্চু ।  তারা দমবন্ধ করে স্মরণ করতো তাদের শেষ অভিজ্ঞতার কথা । অবশেষে প্রতীক্ষার পালার অবসান ঘটে । সেই বাঘের থাবার মতো মুষ্টিবদ্ধ হাত  কিল রূপ ধারণ করে নেমে আসতো শিরদাঁড়ার মধ্যাঞ্চলে । গ্রহীতা হতো ভূমিস্থ । এরপর  কার্তিক স্যার খুব দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যেতেন। তখন বুঝতাম না কিন্তু আজ বুঝি।  ছাত্রদরদী  ওই মানুষটার ভেতরটা ছিল খুবই নরম ।  ওই কঠিন আবরণের ভিতর দিয়ে যেন দুর্বলতা ফুটে না ওঠে, তাই তিনি তাড়াতাড়ি  চলে  যেতেন  সবার অলক্ষ্যে ।

 কার্তিক স্যার প্রায়ই বলতেন – সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী মুষ্টিযোগ  ‘মহিমা’ তিনি কোনোদিন কারোর উপর প্রয়োগ করেন নি, তবে শীঘ্র করবেন । উদ্দেশ্য একটাই –  বিচ্চুদের মধ্যে যারা  সর্বশ্রেষ্ঠ, তাদের মনে ভয় ধরানো । যারা ততদিনে ‘ভীমা” বা ‘মধ্যভীমা ‘ -র   সান্নিধ্য পেয়েছিল, তারা তখন সেই অধরা অচেনা ‘মহিমা’ র প্রচন্ডতার কথা চিন্তা করে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তো ।

 এইভাবে ভালোবাসা আর শাসনে গোটা স্কুলটাকে ধরে রেখেছিলেন কার্তিক স্যার।

 দেশবন্ধু স্কুলে  পড়েছিলাম ক্লাস ফোর পর্যন্ত ।  তারপর বড় স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে একদিন ঢুকে পড়লাম কর্মজীবনে।  মাঝে মাঝে দেখা হতো স্যারের সাথে, যাতায়াতের  পথে ।  দু’চারটে কথা বলতেন । সব থেকে ভালো লাগতো ওর ওই মাথা উঁচু করে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ এ চলা ।  আশপাশের সবার থেকে ছিলেন একেবারে  অন্যরকম –  বলা চলে সর্বোত্তম । 

মাঝে নানান কারণে  দমদম ক্যান্টনমেন্টের  সাথে আমার যোগসুত্রটা আলগা হয়ে গিয়েছিল। বহুদিন পর একদিন বোম্বে থেকে এসেছি কলকাতায় ।  ক্যান্টনমেন্টের চেনা পথ দিয়ে  হাঁটছি । হঠাৎ দেখলাম কার্তিক স্যারকে । 

চমকে উঠলাম । পরনে ময়লা ধুতি আর পাঞ্জাবি । অবিন্যস্ত চুল । গালে সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি ।  বেশ কিছুটা ভুঁড়ি হয়েছে । কোলে এক-দেড় বছরের একটা শিশু। 

শুনেছিলাম,  বুড়ী মায়ের জোরাজুরিতে কার্তিক স্যার বিয়ে করেছিলেন। তখন তার বয়স ষাট ছুই ছুই । কোলে  যে বাচ্চাটা সেটা  বোধহয় ওনারই সন্তান । 

শরীরে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি । দৃষ্টিতে  অবসাদ । আমার দিকে একবারও না তাকিয়ে মন্থর পায়ে এগিয়ে গেলেন তার গন্তব্যের দিকে ।  কোথায় সেই দৃপ্ত ভঙ্গিমা ! কোথায়  সেই বলিষ্ঠ  পদক্ষেপ ! সেই  পরিচ্ছন্ন-পরিপাটি মাথা উঁচু করে চলা মানুষটার এই পরিণতি দেখে মনটা ভারী হয়ে গেল ।  

পথ চলতে চলতে ভাবছিলাম,  যে মানুষটা সারা জীবন তার ব্রহ্মাস্ত্র  ‘মহিমা’ র কথা বলে শুধু ভয় দেখিয়ে গেলেন,  প্রয়োগ করলেন না কোনদিন, আজ ভগবান কি তার উপরই  সেই  ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করলেন। এই কি তোমার বিচার ভগবান! এই কি ‘তোমার মহিমা ‘।