কাকা-কাকী-কুকু

কাকের বাসায় ডিম রাখতে সেদিন গিয়ে দেখি, 

নেবু দিয়ে চোখটি বুজে সাওনা নিচ্ছে  কাকী। 

আমি ভাবলুম এই সুযোগে, 

ডিমটা এবার রেখে আসিগে।  

ঐতো দেখি কোণের দিকে কাকীর পাড়া ডিমগুলো, 

কাকাও নেই আশেপাশে, দিব্বি চোখে দেবো  ধুলো।

এই না ভেবে, মুখটা দিয়ে চাপা  

যেই না গেছি সামনে কয়েক পা ,   

হঠাৎ শুনি কাকীর গলা,

“ আয়রে বাছা কোকিলা,

এবারে আমার বাসায় রাখতে এলি কখানা ?

 দুটোর বেশি এবারে কিন্তু জায়গা হবে না। 

রাখরে বাছা সাবধানেতে আমার গুলোর আগে,

দেখিস যেন এদিকওদিক ছোঁয়াছুঁয়ি না লাগে।  

জানিসতো তোর কাকা আবার বড্ড পিটপিটে, 

সকালসন্ধ্যে দিয়ে বেড়ায় গঙ্গাজলের ছিটে।  

শোনে যদি, লেগেছে তোর ছোঁয়া 

গোবরজলে করবে মাজা ধোয়া।”  

অবাক হয়ে আমি বললাম – “সেকি বলো কাকী !

লুকিয়ে যে ডিম পেড়ে যাই, সেটা জানো  নাকি !”

কাকী দেখি গড়িয়ে হেসে খাচ্ছে লুটোপুটি,  

“ওমা শোনো, কালুমুখী বলছে ইটা কি।  

ভাবিস বুঝি, বছর বছর করবি একই কান্ড 

কিছুই মোরা বুঝি না, এমনি  অপগন্ড !

শোনরে বাছাধন, 

শোনরে দিয়ে মন –

সারাদিন ঘুরে ঘুরে অনেক ময়লা  ঘাঁটি 

পলকেই যাইরে চিনে নকল নাকি খাঁটি।     

নিজের বুকে লালন করে যাদের দি জন্ম,  

সেসব ডিম চিনবো না  – একি মায়ের ধম্মো !

মোদের ডিম, তোদের ডিম প্রভেদ করা বড় দায়,

মায়ের স্নেহে বুকের তাপে সব সন্তান একই হয় !    

পাইনা ভেবে তাই রে আমি , তোরা কেমন করে 

নিজের বাছা ছেড়ে আসিস নিত্যি পরের ঘরে। 

তোদের বাছা বাঁচবে বলে, মোদের ডিম দিস ফেলে !

ফুর্তিতে তাই গান গেয়ে যাস, আমরা ভাসি নয়নজলে।  

তোদের মুখ মিষ্টি, গলা মিষ্টি, মনটা বড় বিষ 

নইলে কি আর একই কান্ড বছর বছর করিস। 

তোদের বাছা বড় করি ফি বছর ই  আমরা, 

ঘুরেও তবু তাকাস না, এমনি মোটা চামড়া।”  

এমন সময় বাইরে শুনে কা কা 

কাকী বললো – “ওই বুঝি এলো তোদের কাকা।”

ঘরে ঢুকে বললো কাকা – “ওমা ওমা, একি  সৌভাগ্য,

আমার ঘরে কোকিলরানী , কোথায় তাকে রাখবো ?” 

কাকী বললো -” রানী তোমার , বিচিত্র এক চোর,

কিছু নেয়না, রাখতে আসে মালপত্তর ওর।  

ধরবো বলে কদিন থেকেই ছিলাম তক্কেতক্কে। ”

কাকা শুনে বললো – “এখন ওসব কথা থাক গে। 

তারচেয়ে বরং এখন বলো, কি শাস্তি দেওয়া চলে ,

এক ঠ্যাঙে দাঁড় করিয়ে রাখি বেলগাছের মগডালে?

কাকী বললো -” হাজার হলেও আজ এখানে, ও আমাদের অতিথি ,

তার উপর ধকল গেছে বড় – আমার মতোই ছিল যে পোয়াতি।

তারচেয়ে ভালো, গোটা কতক গান শুনি ওরে গলায়,

বিনি পয়সায় এমন সুযোগ যায় কি ফেলা হেলায় ?

ওহে বাছা সুন্দরী , গাওতো দেখি বেছে বেছে 

লতা, আশা, সন্ধ্যা – কেমন তোমার এলেম আছে ?”

মনে মনে ভাবলুম আমি  – এখন যা হুকুম দেবে,  

(পড়েছি তোদের হাতে) – গান কেন , নাচও হবে।   

মুখে হেসে  ধীর লয়ে  শুরু করলাম গাইতে গান

কাকা বলছে ” আহা  আহা” , কাকী বলছে “জুড়ালো প্রাণ। ”

কিছুক্ষন পরে দেখি , ভরে গেছে গাছের ডাল ,  

 চড়ুই, শালিখ, পায়রা – বিনি পয়সার শ্রোতার দল ।  

কেউ মারছে সিটি, কেউ বলছে ” ঝাক্কাস”,

তার সাথে শুরু হলো , হাজার গানের ফরমাস  । 

কেউ বলছে  ” ঝুমকা গিরা ” , কেউ বলছে  “লাগ যা গলে ”

“মধু মালতি ” কেউ বলেতো , কেউবা চেঁচায় “জিয়া জ্বলে।”  

কেউ বলে এইটা শোনাও, কেউ বলে ঐটি ,

গোটা বিশেক গান শুনিয়ে তবেই হলো ছুটি।  

নিজের বাসায় ফিরে এলাম – কোকিল বললো – “সখি 

এতো দেরি হলো তোমার? ধরা পড়লে নাকি ?” 

সব কথা সবিস্তারে বললাম তাকে খুলে,

সে বললো – “ওদের কথায় কান দিলে কি চলে !

তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড় এখন, নইলে হবে ঝঞ্ঝাট –

শালের বনে ঝিলের ধারে কাল আমাদের  কনসার্ট।”    

অনেক রাতে  হঠাৎ  করে ভাঙলো দেখি ঘুমটা ,

বাছার জন্য আকুপাকু করলো আমার  মনটা ।   

উড়ে গেলাম সেই দিকেতে , 

কাকা-কাকী যেথায় থাকে।  

দূরের থেকেই শুনতে পেলাম,

 আসছে ভেসে গলা –

মধ্যরাতে বেসুরো বেতালা। 

জোছনা আলোয় যাচ্ছে ভেসে কাকা-কাকীর বাসা,

বুকের তলায় ডিমের মধ্যে ঘুমিয়ে সকল বাছা।  

কোকিল রানী আমি-

 আমার সকল সুরকে যেন হারিয়ে   

একটি মায়ের সুর ,

ভুবন জুড়ে যাচ্ছে কেমন ছড়িয়ে —

“ঘুমপাড়ানী মাসি পিসি মোদের ঘরে এসো 

খাট  নাই পালং নাই খোকার চোখে বসো। “