মানি, হানি ও মানহানি

চিরকাল দাদু-বাবা-কাকা-জ্যাঠাদের মুখে শুনে এসেছি মানিব্যাগ। নিজেও তাই-ই  বলতাম।  কিন্তু, বিয়ের পর বৌ বললো – ” কি যে মানি ব্যাগ, মানি ব্যাগ করো, মনে হয় বাজারের থলি।  যত্তসব গেঁয়ো ব্যাপার।  ওয়ালেট কিংবা পার্স বলতে পারো না।”  সঙ্গে সঙ্গে গুগল ধরে ঝাঁকালাম।  টপ টপ করে মানে ঝরে পড়লো – মানিব্যাগ, থলি , ঝুলি।  মানে বাংলা ভাষার আশ্রয়ে থাকলে  ওই থলি , ঝুলির ঊর্ধে উঠতে পারবো না।  অতয়েব  মুখে ঠুলি। 

সেইদিন থেকে আমার মানিব্যাগ থেকে ওয়ালেটে উত্তরণ।  

সেই ওয়ালেটে বৌ এর ছবি রাখা আমার বহুদিনের অভ্যেস।  মানে যখন মানিব্যাগ বলতাম তখন থেকেই।  ভেবেছিলাম ওয়ালেটে  নিজের ছবি দেখে যদি দয়াপরবশ হয়ে টাকার অঙ্কটা (মানে ঝাড়ার পরিমান) একটু কম করে। কিন্তু না,বরং মাঝে মাঝে আমার সামনেই আমার ওয়ালেট  খুলে ” কি যে একটা পুরোনো ছবি রেখেছো, একটা ভালো ছবি রাখলেই পারো। .যাকগে ২০০০ টাকা নিলাম , আমার কাছে আবার ক্যাশ নেই “,  এই ভণিতায় বিনা ক্লেশে ব্যাগের ভার কমিয়ে দেয়।  কেমন একটা তরঙ্গের মতো আসে, আর ঝড়ের মতো প্রস্থান করে।  ক্যাশ নেই !! আর আমি যেন চলমান এটিএম !  

সমস্যা সর্বত্র। বউয়ের ক্যাশ নেই,  চিন্তায়  চিন্তায় আমারও  কেশ নেই।   তবু মানি ব্যাগে ছবি রাখা ছাড়িনি।  ছেলের জন্মের  পর বৌ এর সাথে ছেলের ছবিও রেখেছি ওয়ালেটে।  ভেবেছিলাম ছেলের জন্মের পর অন্তত এই স্বভাবটার পরিবর্তন হবে।  কিন্তু কোথায় কি !  

অনেকদিনের পুরোনো ওয়ালেট আমার, রং ছিল কালো – ঘামে-ময়লায় এখন ধূসর বিবর্ণ – কোণাগুলোর চামড়া চটে পাঁজরা বেরিয়ে গেছে ।  যে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কভারের  মধ্যে দিয়ে দেখা যেত আমার বৌ-ছেলের ছবি , তার উপরেও ময়লার আস্তরণ পড়েছে।   কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখলাম , ওই স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কভারটা পরিষ্কার ।  বুঝলাম ভেতরটাও  পরিষ্কার হয়েছে।   তখন থেকে আরো সতর্ক হয়েছি।  আগলে আগলে রাখি ওয়ালেট।  ইচ্ছে করে ক্যাশ বেশি রাখি না।  

একদিন একটা পত্রিকা পড়তে পড়তে আবিষ্কার করলাম একটা পুরোনো জোকস ।  খুব আহ্লাদিত হয়ে একটা চিরকুটে লিখে রেখে দিলাম আমার বৌ আর ছেলের ছবির পিছনে – একেবারে জোকস এর বয়ান মতো –  “they  are  my life – they  reminds me  why no money here”  , অর্থাৎ এরাই তারা যারা প্রতিনিয়ত মনে করায় কেন আমি  ট্যাঁকখালির জমিদার ।  

প্রতিদিন ওয়ালেট খুলে দেখি আর খুব হাসি।  অফিস এর সহকর্মীদের দেখাই , তারাও খুব হাসে।  সুযোগ খুঁজছিলাম কবে  বসকে দেখাবো। মানে , রঙ্গরসিকতার মাধ্যমে যদি একটু তেল মারা যায় এই আর কি !   

একদিন  সুযোগ এসেও গেলো।  তন্ময়-ই সাহায্য করলো।  অফিসে আমার পাশেই বসে।  খুব করিতকর্মা  ছেলে।  তেল মারার বিষয়টাকে  একেবারে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ।  

 সেদিন একটা মিটিঙের শেষে , বেরোনোর সময় তন্ময় হঠাৎ আমাকে ডেকে বললো ” কি রে,  স্যারকে তোর মানিব্যাগ এর চিরকূটটা দেখাবি নাকি ? ”  দেখলাম বস দাঁড়িয়ে পড়েছে।  ততক্ষনে আশপাশের সবাই হালকা হালকা হাসছে।  

মালটা এদিকে দেমাকি , মানে দরকার ছাড়া আমাদের সাথে কথা বলে না  সচরাচর , কিন্তু কোথাও নতুন কিছুর গন্ধ পেলে, নিজের  নাকটা সোজা গলিয়ে দেয় ।  বিশেষ করে কেচ্ছা কেলেঙ্কারি হলে। ব্যাটা আবার চরম অভদ্র আর নির্লজ্জ।   যখন তখন যেখানে সেখানে  লোকের সামনে এমন বিচ্ছিরি ভাবে অপমান করে , যে মনেহয় ওর গলা টিপে ধরি।   অফিসে চারিদিকে স্পাই লাগিয়ে রেখেছে , তাই কাউকে বিশ্বাস করে কিছু বলতেও পারিনা।  মাঝে মাঝে তাই  হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে বৌ এর কাছে ওর নামে প্রাণ খুলে গালাগাল করি ।    মানে অফিসের বসের নামে বাড়ির বসের কাছে নিন্দেমন্দ আর কি !  আজ  বোধহয় প্রথম উল্টোটা করার সুযোগ এলো।  

বস বললো ” খুব ইন্টারেষ্টিং কিছু মনে হচ্ছে ! কি ব্যাপার মিস্টার ব্যানার্জী ? সবাই দেখছি হাসছে , মানে আমি ছাড়া সবাই জানে ব্যাপারটা ! “

একটু লাজুক হেসে বললাম ” মানে স্যার , আপনাকে তো ঠিক সেই  ভাবে পাই না। ”  এই বলে ওয়ালেট থেকে সন্তর্পণে চিরকুটটা তুলে বসের দিকে বাড়িয়ে দিলাম।  

পাশ থেকে তন্ময় বললো , ” এইটা ওর মানিব্যাগে সবসময় থাকে স্যার। ”  ব্যাটা তেলবাজ ! শেষ মুহূর্তেও ফুটেজ খাওয়ার চেষ্টা !  

চিরকূটটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ভাঁজটা খুললেন বস।  পকেট থেকে চশমাটা নিয়ে লাগলেন চোখে।  ব্যাটা কিপ্টে বুড়ো , একটা ভালো চশমা পর্যন্ত কেনেনি।  কাগজটা বাগিয়ে ধরে  চশমার নিচের কোন দিয়ে পড়তে লাগলেন।  পড়তে পড়তে বসের মুখের হাসি যত প্রশস্ত হয় , আশপাশের স্তাবকবৃন্দের দন্ত ততই বিকশিত হয়ে ওঠে ।  আমিও গদগদ হয়ে তাকিয়ে আছি বসের মুখের দিকে ।  

হঠাৎ দেখি বসের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। কেমন থম মেরে গেলেন । মুখটা লাল হয়ে গেলো।   আশপাশে আমরা সবাই এর ওর দিকে তাকাচ্ছি । কি হলো রে বাবা !  এতো তাড়াতড়ি আবহাওয়া পরিবর্তনে সবাই বেশ ঘাবড়েই গেছে।   

আচমকা হাতের কাগজটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে , বেশ রাগত স্বরে বললেন ” আপনারা এখনো এখানে কি করছেন ? যে যার নিজের কাজে যান।  এই ভাবে অফিস আওয়ার্স  নষ্ট করতে লজ্জা করে না আপনাদের। “

মুহূর্তের মধ্যে মিটিঙ রুম খালি হয়ে গেলো। ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি  শুধু আমি আর বস।  আমার দিকে না তাকিয়ে  ” মিস্টার ব্যানার্জী, একবার আমার কেবিনে আসবেন ” , বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন ।   

মাটি থেকে কাগজটা তুলে নিলাম আমি।  এতো লোককে দেখলাম , পড়ালাম , সবাই হেসে লুটোপুটি খেয়েছে।  কিন্তু এনার যে কি হলো !  তেল দিতে গিয়ে যে খেল খতম করে দিলাম !

কাগজটা খুলতেই চমকে উঠলাম।  ওপরে আমারি  লেখা –  বড় বড়  করে নীল কালিতে ” they  are  my life – they  reminds me  why no money here .”  তার ঠিক নিচে কালো কালিতে লেখা  “ভিখিরির ওয়ালেট –  তোমার হারামজাদা বস মাইনে বাড়ালেই দেখবে money আছে। ”    এ হাতের লেখা আমার চেনা – আমার বৌ এর।  

মাথার ওপর পাখাটা ঘুরছে বেশ জোরেই ।  তবুও হঠাৎ যেন কেমন গরমে ঘেমে উঠলো শরীরটা ।  মনে হলো যেন মাথাটা ঘুরছে  বনবন করে – মাথার ওপরের পাখাটার থেকেও জোরে।