দ্বিতীয় ভাগ

বাপ রে বাপ, এটা কি “টিকে“, না “টিকে আগুন“?  

প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়ে পুরো একদিন শয্যাশায়ী থাকার পর সজ্ঞানে সুখেন্দুর প্রথম উক্তি।  

বড় ভরসা ছিল তাঁর। একেবারে প্রথম বিশ্বের প্রথমসারির দেশেদের মধ্যে অগ্রগণ্য দেশ – সু ই জা র ল্যা ন্ড। নাম শুনলে চোখের সামনে  ভেসে ওঠে দুধেল গাই, সুস্বাদু চকোলেট, সবুজ  উপত্যকা, বরফসাদা পর্বতমালা, কিংবা নেহাতই বৈষয়িক মানুষ হলে – সুইস ব্যাংক। শুধু কি তাই, এ দেশটা হলো পৃথিবীর বহু যুগান্তকারী ওষুধ বা প্রতিষেধক এর আঁতুরঘর। তাবড় তাবড়  ওষুধ প্রস্তুতকারক দেশের হেড অফিস এখানে। তার উপর এই সুইস মুলুকে যে টিকা পেতে চলেছে সে, তার মালিকানা মার্কিনী কোম্পানি Moderna -র হলেও, এই টিকার আসল  রূপকারতো সুইস কোম্পানি Lonza – তার বৌয়ের কোম্পানি। এই  Lonza এর  ল্যাবেই জন্ম নিয়েছে এই টিকা।  সুখেন্দু রসিকতা করে বলে – বৌয়ের কোম্পানির প্রোডাক্ট, এক অর্থে  এ টিকা তার শ্বশুরবাড়ির প্রোডাক্ট।  

বড় সৌখিন ও মসৃন জীবনযাত্রা এখানকার সুইস মানুষদের। তাই তার মনে হয়েছিল, এখানকার টিকা আর পাঁচটা হেঁজিপেঁজি দেশের মতো হবে না। এই ধরো, আমাদের পোড়া দেশে  কি হয় – কোনো গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই এক ভীমদর্শিনী নার্স এসে খপ করে ধরলো তোমার হাত, আর তারপর ঘপাৎ করে বসিয়ে দিলো একটা ছেনিসদৃশ সূঁচ -খানিকটা ভেজা তুলো  ডলে দিয়ে বলবে “এবার নিজে তুলোটা চেপে ধরো – আর ডলতে ডলতে বাড়ি চলে যাও”।  ব্যস হয়ে গেলো টিকা ! দূর দূর, না আছে রোম্যান্স, না আছে রোমাঞ্চ, শুধু রক্ত, ব্যথা, আর আতঙ্ক।  

সুখেন্দু তার কল্পনার সুইস ভ্যাকসিনে চড়ে পাড়ি দেয় এখানে ওখানে। এক সুন্দরী সুইস রমণী একটি সুদৃশ স্ফটিকাকার পাত্রে রঙিন তরল নিয়ে প্রবেশ করলো আলোছায়া ঘেরা এক ঘরে। ওষ্ঠে স্মিত হাসি, শরীরের ভঙ্গিমায় লাস্য, চোখের ভাষায় অপ্রতিরোধ্য ইঙ্গিত। ভেসে এলো এক মায়াবী কণ্ঠস্বর। সে হা করে তাকিয়ে আছে সেই মেমবেশী উর্বশীর দিকে  (সুইস জার্মান এর  বিন্দুবিসর্গ বুঝতে না পেরে)। অতঃপর সেই উর্বশী তার হাতের মুদ্রায় ঢেউ খেলিয়ে মৃদু উচ্চারণে বললো “bitte” (প্লিজ )।

 তার সেই প্রসারিত মুদ্রার সার্বজনীন অর্থ বুঝতে আর দেরি হয়না ওর। মন্ত্রমুগ্ধ সুখেন্দু এলিয়ে পড়ল সামনে রাখা নরম  বিছানায়।

এরপর সেই মায়াবিনী তার অঙ্গুলির জাদু স্পর্শে মাথায় চাম্পি করতে করতে লাগিয়ে দিচ্ছে সেই তরল প্রতিষেধক – তলিয়ে যাচ্ছে সুখেন্দু সুখসাগরের গভীর থেকে আরো গভীরে – অতলান্তে।  প্রতিষেধকের সঞ্জীবনী সঞ্চারিত হচ্ছে শিরায় উপশিরায় -কোষ থেকে কোষান্তরে।  সেই আন্দোলনের প্রাবল্যে জাগতিক সব কিছু  ভেসে গেলো – কোথায় বেদনা, কোথায়  করোনা!

যেদিন সুখেন্দু জানতে পারলো, এই সুইস মুলুকেও টিকা সেই সূঁচ ফুটিয়ে দেবে, বড় আশাহত হলো সে। খানিক অনুযোগের সুরে ইলোরাকে বলতেই ফোঁস করে উঠলো ও –

– মানে? ছোটবেলা থেকে কোনোদিন টিকা নাওনি নাকি ! না কাউকে কোনোদিন নিতে দেখোনি ?

–  কেন, oral টিকা হয়না? তোমার কোম্পানি ওই ইনজেকশন না বানিয়ে oral dose ও তো বানাতে পারতো? শুধু শুধু এই ইনজেকশন বানানোর কি প্রয়োজন কে জানে!

– তোমার মুখে যদি একটা মুক্কা মেরে চৈতন্য ফেরানোর প্রয়োজন ঘটে, তখন তোমার হাতে চিমটি কাটলে কাজ হবে কি ?

– হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি বুঝেছি,  অগ্নীশ্বরের উত্তমকুমারের মতো ডায়ালগ ঝাড়তে হবেনা। কোথায় ভাবলাম সুইস ভ্যাকসিন …….

– আমিও যা বোঝার বুঝেছি। সূঁচে যে তোমার ভয় সে যেন আর আমি জানি না। আবদার কত ! ওনার জন্য ওরাল ভ্যাকসিন বানাতে হবে! শুনে রাখো, সেও খুব তাড়াতাড়ি আসবে, কেউ না  কেউ নিশ্চয়ই বানাবে, কিন্তু ততদিন তুমি তাহলে গৃহবন্দী হয়ে থাকো।    

কথাটা খুবই সত্যি।  সুখেন্দুর বরাবর এই ইনজেকশন, কাঁটা ছেঁড়াতে খুব ভয়। তাই অ-সূঁচী সুইস ভ্যাকসিনের আশায় জল পড়তেই তাঁর মনের ভিতর কোথায় একটা খচখচ করতে থাকলো। বুকে একটাই বল বাকি – সুইস নার্স। উর্বশী নাহোক, কর্মপটিয়সী এক নারী, যিনি নিপুণ হাতে তাকে ভ্যাকসিন inject করবেন। সেই আশায় বুক বেঁধেই প্রথম ডোস নিতে গিয়েছিলো  সুখেন্দু। ইলোরারও appointment ছিল একই দিনে একই সময়ে। অগত্যা পুত্র গোলকি-কেও নিয়ে যেতে হলো লেজে বেঁধে। 

কাজের দিন সন্ধেবেলা, তবু সেদিন সেন্টার এ  ভিড়টা একটু বেশি-ই  ছিল। তাও  গোটা প্রক্রিয়াতা  আধ ঘন্টাতেই শেষ হয়ে গেছিলো। গোল বাঁধলো পরের দিন। 

সকাল থেকে একটু একটু করে জেঁকে বসলো। প্রথমে ইলোরা, তারপর সুখেন্দু  – একেবারে শয্যাশায়ী। গোটা দিনটা কেটে গেলো একটা ঘোরের মধ্যে। কখন খেলো, কখন শুলো, গোলকি কি করলো – সবি যেন ধোঁয়াশা। সারাদিন মাথাটায় যেন ৫ মণ ভার কে চাপিয়ে রেখেছে।  

মাথার ভারটা কাটলো তার পরের দিন সকালে। চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিয়েই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো 

— বাপ রে বাপ, এটা কি “টিকে”, না  “টিকে আগুন” ? কাল যা অবস্থা হয়েছিল তাতে টিঁকে থাকবো কিনা সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।  

— বা বা, সকাল সকাল শিবরাম চক্কোত্তি ভর করলো না কি ?  

— শিব্রাম না রামনাম – একেবারে সত্য হয়ে যাচ্ছিল।  

— সক্কালবেলা যত অলক্ষুনে কথা। সবে মাথা ব্যথাটা গেছে, এখন তুমি প্লিজ মাথা ব্যথার কারণ হয়ো না। স্ট্রং ভ্যাকসিনে ওরকম একটু আধটু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়।

স্ট্রং বলাতে ইলোরা যতটা জোর দিলো, ভিতর থেকে ততটা “স্ট্রং” মনে হলো না সুখেন্দুর। তার সাথে সচেতনভাবে এই বিশেষ বাংলা “পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া” ! side effect বললে অনেকটা  স্বাভাবিক হতো।  মানে, সুখেন্দুর মতো ইলোরাও ঘাবড়েছে কিছুটা। তাই আর কথা বাড়ালো না সুখেন্দু। 

বেলা বাড়ার সাথে সাথে শরীরও চাঙ্গা হয়ে উঠলো। ইতিমধ্যে ভিডিও কলে সুইস বার্তা সম্প্রচারিত হয়েছে  ভারতবর্ষে। আজ শনিবার ছুটির দিন, তাই বিস্তারিত সংবাদের দিন। তবে এই  মুহূর্তের প্রধান খবর অবশ্যই সুখেন্দু-ইলোরা-দের ভ্যাকসিন ভোগান্তি। একটু  বেলার দিকে সুখেন্দু ঘর থেকে বাইরের দালানের দিকে আসতে আসতে শুনতে পেলো ওর শাশুড়ী বলছে  –

— কি জানি বাপু।  আমাদেরতো ২ দাগ টিকে হয়ে গেলো, সামান্য একটু গা ম্যাজ ম্যাজ ছাড়া তো কিছুই হলো না।  

বোঝো কান্ড ! আমরা গালাগাল দিচ্ছি এই ভোগান্তির জন্য, আর উনি আপসোস করছেন কিছু না হবার জন্য!  

মেয়ে কিন্তু বুঝিয়েই চলছে। 

— আরে সব ভ্যাকসিন কি এক হয় নাকি ? এক একটা এক এক প্রসেসে তৈরী। Moderna একটু স্ট্রং, তোমাদের কোভাকসিনে বা কোভিশিল্ড অনেকটা light। 

— তুই যাই বলিস, আমার কেমন জানি সন্দেহ হচ্ছে। ভ্যাকসিন-ই দিয়েছে তো ? জলটল দেয়েনিতো।  

— কি যে বোলো মা।  

ইতিমধ্যে সুখেন্দু কে দেখেই ওর দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে দিলো ইলোরা।  

— কেমন আছো এখন সুখেন্দু?

— হ্যাঁ, এখন পুরোপুরি সুস্থ মা । 

— না না, এখনো চোখ মুখ সব বসে আছে। বেশি স্ট্রেস নিও না। কম্পিউটার নিয়ে বসে থেকো না। সকাল সকাল খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ো।  

— আর শোয়ার কথা বলবেন না, মা।  কাল সারাদিন শুয়ে থেকে মাজা-কোমরের যা হাল, শোয়া শুনলে এখন আতঙ্ক লাগছে। 

— তাহলে বসে বসেই না হয় একটু ঘুমিয়ে নিও। এ ব্যাপারেতো তোমাদের শ্বশুর জামাই-এর জুড়ি মেলা ভার।  যে কোনো সময় যে কোনো অবস্থায় – দাঁড়িয়ে শুয়ে বসে তোমরা ঘুমোতে  পারো।  

— ওটাকে ঘুম বলে না মা, deep meditation – অনেক সাধনা করে অর্জন করতে হয়। আশেপাশে যখন বাজে অর্থহীন বকবক শুরু হয়, তা সহ্য করতে না পেরে কিছু মানুষ গৃহত্যাগী হন। আর যারা সহ্য করে থেকে যান তাদের মধ্যে কেউ কেউ ডুব দেন গভীরে – নিজের মধ্যে। দেখে মনেহয় ঘুম, আসলে এ হলো deep level of meditation। এ ব্যাপারে আমার গুরু  আমার শ্বশুর মশাই।  

— ভ্যাকসিন এর ঘোর এখনো কাটেনি দেখছি – মাথাটাও শেষমেশ  ……… যাকগে  সেসব কথা। এক দিকে প্রথম dose টিকা নিয়ে তোমাদের এই হাঁড়ির হাল, আর এদিকে দুটো dose নিয়েও আমাদের কিছুই হলো না। আমার দিব্বি সন্দেহ হচ্ছে সিরিঞ্জ ভরে জল দিয়েছে। মিমিকে পর্যন্ত দিয়ে দিলো, আর আমরাতো সাধারণ মানুষ ।  

— কে মিমি ?

— ওমা তুমি মিমি কে চেনো না? অতবড় অভিনেত্রী। কত সিনেমা সিরিয়াল করেছে। এবার তো তৃণমূলের হয়ে জিতলো। শোনোনি, ওকে টিকা দেবার নামে অন্য কিছু একটার  ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে। ওই ধনঞ্জয় না কি ছোঁড়াটার নাম ? ভাবো একবার!  কি দিয়েছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। 

ইতিমধ্যে ইলোরা উঠে গিয়েছিল রান্নাঘরে। ওখান থেকেই চেঁচিয়ে বললো “ধনঞ্জয় না, দেবাঞ্জন – উল্টোপাল্টা নাম বোলো না। “

– আপনার মেয়ে বলছে ধনঞ্জয় না, ওর নাম দেবাঞ্জন – দেবতার চোখের কাজল।  

– হতভাগার আবার নাম ! দেবতার চোখের কাজল না ছাই – ও হলো যমের চোখের কাজল।      

হ্যাঁ , খবরটা সুখেন্দু ও পড়েছে।  হোয়াটস্যাপ  ভরে গেছে forwarded মেসেজে। বাঙালির নাম একেবারে ডুবিয়ে ছেড়েছে।  

— কিন্তু আপনারাতো হসপিট্যাল থেকে নিয়েছেন, ওগুলো সব জেনুইন। 

— কি জানি বাবা। .যে দেশে ত্রানের ভালো চাল-গম সরিয়ে বাজে জিনিস দেওয়া হয় সে দেশে সব হতে পারে।  

বিষয়টা রাজনীতির দিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে, সুখেন্দু আতংকিত হলো। বিশেষ করে বঙ্গ রাজনীতি প্রমীলাপ্রধান হবার পর থেকে সে কোনো মহিলার সাথে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেই ভয় পায়। তাই বিষয়টা কি ভাবে অন্য দিকে ঘোরানো  যায় এটা ভাবতে ভাবতেই এসে গেলো সুযোগ।  শাশুড়ি বললো –

– কেনো যে ছাই আমাদের এখানেও ওই তোমাদের ম্যাডোনা টিকা দিলো না।  

সুখেন্দু হাসি চাপতে পারলো না। নাম ওলোটপালোট করাটা শাশুড়ির প্রায় একটা মুদ্রা দোষের মতো। এবং সেটা বাকি আর পাঁচটা কাজের মতো উনি করেন বসে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। ভুল সংশোধন করে দিলেও অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে তার কোনো প্রভাব তার আত্মবিশ্বাসে বা স্বভাবে পড়ে না। তাই সংশোধনের পথ ছেড়ে প্রায় সবাই এখন এটাকে উপভোগ করে। ব্যতিক্রম শুধু ওনার মেয়েরা। তারা আজও প্রতি পদে বিব্রত হয় এবং সংশোধনের পথ ছাড়েনা । 

ইতিমধ্যে ইলোরা ফিরে এসেছে রান্নাঘর থেকে। সুখেন্দুর হাসিতে আরো বিব্রত হয়ে প্রায় ধমকের সাথে বলে উঠলো, 

– ওফ মা, তুমি পারোও। আবার সেই উল্টোপাল্টা নাম?

– কেন কি বললাম ?

– কি বললাম ? টিকার নাম মডার্না – ম্যাডোনা নয়। আমাকে বলেছো বলেছো, আর কাউকে বোলো না। অবশ্য তোমাকে ভরসা নেই, হয়তো রাজ্যের লোককে বলে বসে আছো।  

– কি ভুল বলেছি , বোল্লামতো মর্ডাননা। 

– আবার ভুল বলছে। আরে বাবা, মডার্না  …. ম , ডার , না ।

এখন বেশ কিছুক্ষন এই পর্ব চলবে। বাংলা বর্ণের যতরকম বিপর্যয় হওয়া সম্ভব, শাশুড়ি ঠাকুরণ করে দেখবেন।  আ – কার, ই-কার, রেফ, সব লাফিয়ে লাফিয়ে পরস্পরের সঙ্গে  স্থানবিনিময় করবে। আর ওনার মেয়ে তার সাথে তিড়িংবিড়িং করে লাফাবে। 

সেই বিপর্যয়ের আশু সম্ভাবনায় সন্তর্পনে সেই স্থান থেকে কেটে পড়লো সুখেন্দু। কিছুক্ষন বাদে বাথরুম যাবার সময় তার কানে ভেসে এলো শাশুড়ির টোটকা।  

— শোন, সুখেন্দু আর তোর যা হাল দেখছি — শরীর গরম হয়ে গেছে, এরপর অ্যাসিড রাখবে। এই সময় একটি মৌরি-মেথির জল খেতে পারলে ভালো হতো, কিংবা মিছরি………….. ঘরে বাতাসা আছে ? …………………………..

সুখেন্দু মানসচক্ষে দেখতে পেলো, আগামী বেশ কিছুদিন সুইস আকাশে আয়ুর্বেদ আর হোমিপ্যাথির ঘনঘটা। তার বুকের অন্তঃস্থল থেকে কে যেন গেয়ে  উঠলো “ওই মহাসিন্ধুর  ওপার থেকে কি সংগীত ভেসে আসে। ……….” ।  

~~~~~ : ~~~~~~

সেবারের সে ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে উঠতেই আবার চলে এলো দ্বিতীয় ডোসের দিন, ঠিক এক মাস পরে। ইতিমধ্যে নানান তত্ত্বের উদ্ভব ও চর্চা হয়েছে। কেউ বলছে ‘তোমাদের প্রথম ডোসে  বেগ দিয়েছে, দ্বিতীয় ডোস তোমাদের কাছে নস্যি।’ কেউ বলছে ‘যাদের একবার কোভিড হয়েছে, তাঁরা ইমিউনিটি এতো স্ট্রং, তাদের ওপর বুস্টার ডোসের কোনো প্রভাবই নেই।’  আবার কেউ কেউ বলছে ‘প্রথমটা আর কি করেছে, দ্বিতীয়টা দেখো না !’ সুখেন্দু এই সব চর্চাতে না বিশেষ অংশগ্রহণ করতে চায়, না বিশেষ একটা আমল দিতে চায়। ওর কাছে এখন  একমাত্র তত্ব ‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’

গতবারের “ঝাড় খাওয়া” অভিজ্ঞতায় এবারে যুদ্ধের প্রস্তুতি অবশ্য অনেকটাই ভালো। দুদিন আগে সারা সপ্তাহের বাজার করে আনা হয়েছে। আগামী দুদিনের খাবার দাবার  রান্না করে  ফ্রিজের তাকে তাকে ভরে রেখেছে ইলোরা।  মানে নড়তে নড়তে উঠে এসে ফ্রিজ থেকে বার করে শুধু গরম করে নিলেই হলো। 

এখন গরম কাল তাই রাতে পাখা চালিয়ে রাখলে ভোরের দিকে একটা পাতলা চাদরেই কাজ হয়ে যায়।  কিন্তু গতবারে টিকা নেবার পর যখন প্রবল শীত করছিলো  তখন বিছানার তলার  স্টোরেজ থেকে লেপ-কম্বল বার করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।  সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারে ৪ টে কম্বল বার করে বিছানার কাছাকাছি রেখেছে ওরা।     

ডোসের সাথে পেইন কিলার নাকি একেবারে আদায় কাচঁকলায় সম্পর্ক।  তাই শাশুড়ির পরামর্শ মতো, আপাত নিরীহ কিন্তু অতীব শক্তিশালী সাদা সাদা হোমিওপ্যাথির  বড়ি প্রস্তুত  বিছানার শিয়রে রাখা বেডসাইড টেবিলে।

সুখেন্দুর আবার ওই হোমিওপ্যাথির সাথে বিশেষ সখ্যতা নেই ছোটবেলা থেকে। ওর এক খ্যাপাটে কাকা ছিল হোমিওপ্যাথির অন্ধ ভক্ত। উঠতে বসতে খেতেন ওই সাদা বড়ি গুলো।  ঠাকুরদা ওকে ক্ষেপাতে বলতেন ‘হোমিওতে যার সমীহ, ভগবান তারে ক্ষমিও।’ তাতে অবশ্য সেজো কাকার ক্ষেপামি কিছু কম হতো না।

 সব থেকে অসহ্য লাগতো ওই বড়িগুলো খাবার ভঙ্গিমা দেখে। লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে ওরে সেই খোপ খোপওয়ালা কালো কাঠের বাক্সটা নিয়ে বসতেন বারান্দায়। হাতে বড়ির শিশিটা নিয়ে, মাথাটাকে উর্দ্ধমুখে করে একটা লম্বা জিভ বার করে তাতে ঠিক ৮ টি বড়ি ঢালতেন। ওফ, সে এক দৃশ্য – ৭ টা নয় ৯ টা নয়, ঠিক ৮ টা ঢালতে হবে। বড়ি প্রত্যাশী প্রসারিত লেলিহান জিহ্বা – শিশিতে নিবদ্ধ একজোড়া ট্যারা চোখ – দেহভঙ্গি বিকৃত – ঘামে ভেজা মেদবহুল বক্ষ ও উদর – উত্থিত উন্মুক্ত বাহুমূলের নিম্ন্যাংশের অপরিচ্ছন্ন ও ঘর্মাক্ত কেশরাশি। সবমিলিয়ে এই দৃশ্যটা, সুখেন্দুর মনে একটা দুঃস্বপ্নের মতো জড়িয়ে আছে হোমিওপ্যাথির সঙ্গে । 

তবুও হাল্লার রাজার থেকে “নিস্তার নাই কাহারও সটকে” । দুবার প্রত্যাখ্যান করলে অন্তত একবার সুখেন্দুকে জিভ বার করে নিতে হয় অমৃত দানা । 

অবশেষে এলো সেই বহুপ্রতীক্ষিত দিন। ভ্যাকসিন এর দ্বিতীয় ডোসের  দিন।  এপয়েন্টমেন্ট সন্ধেবেলা।

 সুখেন্দু আর ইলোরা দুজনেই আজ “ওয়ার্কিং ফ্রম হোম।”  কেন জানি সকাল থেকে একটা মানসিক অশান্তিতে ভুগছে সুখেন্দু।  বার পাঁচেক প্রাণায়াম করেও বশে আনতে পারছে  না মনকে। কাজে মন না বসায় লাঞ্চ এর পর হাফ ডে নিয়ে নিল। তাতে অশান্তি বাড়লো বই কমলো না।  

লাঞ্চ খেতে খেতে অনেকটা নীরবতা ভঙ্গ করার স্টাইলে সুখেন্দু বললো ‘গতবারে বাঁ হাতে নিয়েছিলাম, এবার ডান হাতে নি কি বলো ?’       

ইলোরা খেতে খেতে মোবাইল দেখছিলো।  একেবারে ভূমিকা ছাড়া ঠিক কি বিষয়ে কথা বলছে সেটার আনুমানিক আন্দাজ করে বললো , ‘না না ডান হাতে নিও না, খামোকা হাতাটা  এঁটো হয়ে যাবে’ । 

– আরে কি মুশকিল কিসের হাতা ?

– ডালের হাতা – আবার কোন হাতা হবে ?

– ওফফ, মোবাইল দেখাটা বন্ধ করতো।  আমি বলছি ভ্যাকসিন এর কথা। গতবারে বাঁ হাতে নিয়েছিলাম, এবার কি ডান হাতে নেবো ?

– এমন একটা ভাব করছো যেন মতাদর্শ বদল করছো ! বামপন্থা নেবো না দক্ষিন পন্থা? একটা কাজ করো, কোনো হাতে নিও না, কপালে নাও।  লোকে তো ওখানেই টিকা পড়ে।  তুমি  নাহয় টিকা নিলে।  “জয়টিকা চর্চিত ভাল, গলে দোলে বিজয়মাল, হে বীর পূজিত তুমি যুগে যুগে। ..”  

– হ্যাঁ, জয়টিকা ! কপালে যে কি নাচছে কে জানে! হাত বদল করলে কি আর কপাল বদলাবে ? যা হবার তাই হবে।  

শেষের কথা গুলো প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলে সুখেন্দু।  

সন্ধ্যে ছটার মধ্যে ডিনার সেরে দুগ্গা দুগ্গা বলে তিনজনে বেরিয়ে পড়লো ভ্যাকসিন সেন্টারের উদ্যেশ্যে। মিনিট চল্লিশেকের পথ। প্রথমে ট্রাম, তারপর বাস। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ও  এতটা আরামের যে যাত্রাপথের কোনো ক্লান্তি স্পর্শ করতে পারে না। না আছে ভিড়ভাট্টা, কোলাহল, না শব্দ-ধোঁয়া-দূষণ। তার ওপর সব কিছু চলে একেবারে ঘড়ির কাঁটা মেপে।  

এবার ভ্যাকসিন সেন্টারে ভিড়টা অনেকটাই হালকা। ওখানে পৌছিয়ে সুখেন্দুর মনে হলো টেনশনটাও অনেকটাই   নিয়ন্ত্রণে।  গতবারের অভিজ্ঞতাতে এবারে কোথায় কি করতে  হবে সবটাই জানা, তাই আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল ওরা।

 যেমন ঢোকার গেটে সুইস দারোয়ানকে মোবাইল খুলে এপয়েন্টমেন্ট এর এসএমএস দেখাতেই বিনাবাক্যব্যয়ে ভিতরে ঢুকতে দিলো। এরপর মূল বিল্ডিং এ আই ডি কার্ড  আর  এপয়েন্টমেন্ট এর সময় বলতেই কম্পিউটার খুলে তথ্য মিলিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলো একটা করে বোর্ডে আটকানো ফর্ম আর পেন। 

হাতে ফর্ম নিয়ে ভিতরে ঢুকেই একটা বসার জায়গা – অনেকগুলো চেয়ার পরপর রাখা । ওখানে বসেই ফর্মটা ভর্তি করতে হবে।

  সোশ্যাল ডিস্টেন্সিঙ এর জন্য প্রত্যেকটা চেয়ার অন্যটার থেকে ৩ ফুট দূরে।  সুখেন্দু আর ইলোরা দুজনে দুজায়গাতে গিয়ে বসলো। গোলকি বরাবর বাবা মা এর মাঝখানে বসে।  কিন্তু  এই ব্যতিক্রমী ব্যবস্থায় মাঝখানে কোনো বসার জায়গা না পেয়ে খানিকটা পিংপঙ বলের মতো এপাশ ওপাশ করে শেষে মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো।        

ফর্মটা আগাগোড়াই জার্মান ভাষায় লেখা। তবে আগেরবার ওই একই ফর্ম থাকায় কোথায় কি লিখতে হবে দুজনেরই জানা আছে।  সুখেন্দু খুব যত্ন সহকারে লিখতে আরম্ভ করলো।  প্রথমে  নাম, ঠিকানা, জন্মদিন, গোত্রবিত্রান্ত ইত্যদি। পাশ থেকে হঠাৎ শুনতে পেলো – ‘এই যে, হাতের লেখার পরীক্ষা দিচ্ছ নাকি ? একটু তাড়াতাড়ি লেখো’ । সুখেন্দু  না শোনার ভান করলো। এরপরে ফর্ম এ একগুচ্ছ হ্যাঁ/না, এর প্রশ্ন। এই সমস্ত প্রশ্ন বেশির ভাগই রোগের বর্তমান ও ইতিহাস সংক্রান্ত।

গতবারে গুগল ট্রান্সলেটর দিয়ে পড়ে পড়ে ফর্ম ভর্তি করতে করতে সুখেন্দুর চিত্তি চক্কর দিতে আরম্ভ করেছিল।  বাপরে – কি সব প্রশ্ন!  গত ৬ মাসে তোমার নিউমোনিয়া হয়েছে কিনা ? গত ৬ মাসে তোমার হার্ট এটাক হয়েছে কিনা? তোমার গাঁটে গাঁটে ব্যথা কিনা? তোমার মধ্যে করোনার  কোনো লক্ষণ আছে কিনা ? তোমার ত্রিকুল গুষ্ঠির কারুর করোনা হয়েছে কিনা ? সব কটা প্রশ্নর উত্তরই না, কিন্তু এক সঙ্গে এতগুলো রোগের নাম শুনেই কেমন কেমন যেন লাগে সুখেন্দুর। তাই তাই এবারে বিনা দ্বিধায় চোখকান বুজে পর পর “না” এর ঘরে টিক দিয়ে  এগিয়ে গেলো ও।  এরপর নির্দিষ্ট জায়গাতে সই করে মাথাটা তুলেই দেখলো ইলোরা নেই পাশে – মানে ফর্ম ভর্তি করে কাউন্টারে চলে গেছে। 

এর পরের ধাপ, জায়গায় বসে হাত তোলা – অনেকটা ছোটবেলার স্কুলের মতো। মানে হাত তুলে ইঙ্গিত করতে হবে ‘আমার ফর্ম ভর্তি করা হয়ে গেছে সুইস দাদা, এবার কোন পথে যেতে  হবে?’  একজন সুইস গার্ড একটু দূরেই পায়চারি করছে। সুখেন্দু হাত তুলতেই তাকে বাঁয়ে কাউন্টার নম্বর ৯ এ যেতে বললো।

 সুখেন্দু গুটিগুটি পায়ে সেই দিকে চলতে শুরু করতেই হঠাৎ পিছন থেকে ইলোরার গলা পেলো ‘এই যে এই কাউন্টারে এসো।’ সুখেন্দু ঘুরে দেখলো অন্যদিকের একটা কাউন্টার থেকে ইলোরা ডাকছে। দিক পরিবর্তন করে সেই দিকে এগোতেই চোখেমুখে একটা প্রশ্ন নিয়ে সুখেন্দুর দিকে একটা বিশেষ ভাবে তাকালো সেই সুইস গার্ড।

 সুখেন্দু একটু আধাহাসি মুখে নিয়ে ইলোরার দিকে একটা আঙ্গুল তুলে বললো ‘মাইনে ফ্রাউ’ অর্থাৎ “আমার বৌ”। সুখেন্দুর জার্মান ভাষার দৌড় ওই পর্যন্তই।

 ইলোরার দিকে একবারও না তাকিয়ে গার্ড ভদ্রলোক একটু হেসে মাথাটা নাড়িয়ে বললেন ‘কাইনে প্রবলেমা’ অর্থাৎ “কোনো ব্যাপার না”। ওর হাসি আর ঘাড় নাড়ার কায়েদা  দেখেই  সুখেন্দু বেশ বুঝতে পারলো, ব্যাটা বলতে চাইছে ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, যাও যাও। আমিও বুঝি, সবার উপরে বৌ সত্য, তাহার উপর নাই।’

কাউন্টারে পৌঁছতেই গোলকি বললো ‘বাবা ঐদিকে যাচ্ছিলে কেন? মা ঠিক বলেছিলো, তুমি উল্টো দিকে যাবে।’ ব্যাটা একেবারে মায়ের চেলা হয়েছে। 

ইলোরা বললো ‘ঠিক জানতাম তুমি অন্য দিকে যাবে, তাই গোলকিকে বলে রেখেছিলাম, বাবা অন্য দিকে গেলেই আমাকে বলবি। ফ্যামিলি হলে এক কাউন্টারে যেতে হয়, জানো না ? গতবারের কথা মনে নেই? ‘

— বা বা, ফ্যামিলি হলে এক কাউন্টারে যেতে হয় জানো, কিন্তু একসাথে যে যেতে হয় সেটা জানো না! আমার জন্য অপেক্ষা না করে, না বলেতো চলে এলে।  

– তাড়াতাড়ি এলাম বলেই না কাউন্টারে এসে কাজটা এগিয়ে রাখলাম। তোমার মতো হাতের লেখা প্রাকটিস করলে হতো ?

– ২ মিনিট আগে এসে কি এমন উদ্ধার করেছো ?

হঠাৎ গোলকি এসে সুখেন্দুর হাত টেনে বললো ‘বাবা, মায়ের সাথে তক্কো করতে হয় না জানো না?’ ব্যাটার মাত্র আট বছর বয়েস, কিন্তু এর মধ্যেই বেশ বুঝে গেছে, সংসারের বস কে। প্রত্যেক তর্কে কে জেতে। তাই আগে থেকেই যুদ্ধ বিরতির ছলে বিজয়ী ঘোষণা করে দিলো। 

আর কথা না বাড়িয়ে কাউন্টারের ওপাশের ভদ্রমহিলাকে কাঁচের জানলার  ফাঁক দিয়ে ফর্মটা গলিয়ে দিলো সুখেন্দু।  

ইলোরার ধৈর্যতা চিরকালই একটু কম। নিজের উচ্চতা থেকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না বলে পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে কাঁচের জানলার ওপারে কি হচ্ছে দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। ভদ্রমহিলা যত্ন সহকারে নিজের কাজ করছেন। একটু করে ফর্মটা দেখছেন আর কম্পিউটারে এন্ট্রি করছেন। ইলোরারটা আগেই হয়ে গেছে। এখন সুখেন্দুর ফর্মটা নিয়ে কাজ করছেন। সুখেন্দু লক্ষ্য করলো, ভদ্রমহিলা হঠাৎ যেন চশমার ফাঁক দিয়ে ওর দিকে একঝলক তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলেন।

 ব্যাপারটা ইলোরার দৃষ্টিও এড়ায় নি। সুখেন্দুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো ‘নিশ্চয়ই কিছু গন্ডগোল করেছো।’      

– কি আবার গন্ডগোল করবো ! সেটা হলেতো বলতো।  

– কি জানি বাবা, তোমাকে ভরসা নেই।  

কৌতূহল বেশিক্ষন চেপে রাখতে পারলো না ইলোরা। কাঁচের জানলার কাছে মুখ নিয়ে একটা অমায়িক হাসি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো ‘any problem Maam ?’

 ভদ্রমহিলা আবার সেই ফিচকে হাসি দিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন ‘no problem at all. I see here he is not pregnant।’

এতক্ষনে মানেটা পরিষ্কার হলো সুখেন্দুর কাছে। ফর্ম এর একটা প্রশ্ন ছিল, তুমি কি প্রেগন্যান্ট ? প্রশ্নের আগে ব্রাকেটের মধ্যে লেখা ছিল “nur für frau”, মানে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য। গণ টিক দিতে দিতে সুখেন্দু সেটার পাশের “না” তেও টিক দিয়েছে। 

বিব্রত সুখেন্দু ইলোরার দিকে তাকাতেই ও শুধু দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে ঘাড় নাড়লো। যার মানে, তুমি পারোও বাবা!

কিছুক্ষনের মধ্যে ভদ্রমহিলা দুজনের ফর্ম -সমেত ক্লিপ-বোর্ড ফেরত দিয়ে ভ্যাকসিন নেবার বিশেষ অঞ্চলের দিকে যেতে বললো। 

গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ওরা সেদিকে। সেখানেও একজন সুইস গার্ড ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করছেন।  একদিকে গোটা বারো ঘর, দেখে মনে হয় সাময়িক ভাবে বানানো। ওগুলোর  ভিতরেই টিকা দেওয়া হবে। ওটার উল্টো দিকেই বসার ব্যবস্থা।  গার্ড ভদ্রলোক বেশ দক্ষতার সাথে আগত টিকা প্রার্থীদের সেখানে বসাচ্ছেন সোশ্যাল ডিস্টেন্স মেনে। 

এমনিতে সুখেন্দু বেশ ধৈর্য্যশীল, কিন্তু প্রতীক্ষা ব্যাপারটা বড় একটা সহ্য করতে পারেনা। তার উপর এই টিকা নেবার জন্য প্রতীক্ষা। ওদের আগে বড়জোর পাচঁজন। খুব বড় জোর  পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু সুখেন্দুর মনে হলো পাঁচ যুগ। গলাটা একটু শুকনো শুকনো লাগছে। জল আছে ইলোরার কাছে, কিন্তু চাইতে গিয়েও চাইলো  না। একেবারে  টিকা পর্ব শেষ করে খাবে সে।  

ঠিক ওদের আগের লোকটার ডাক পড়তেই ইলোরা বললো ‘আমরা কিন্তু একসাথে যাবো, একই ঘরে।’ এটা খানিকটা হলেও স্বস্তি দিলো সুখেন্দুকে। একটু পরে যেই একটা ঘরের আলো সবুজ হলো, ইলোরার ডাক পড়লো। ও এগিয়ে গিয়ে গার্ডকে ভাঙা জার্মানে জানালো ‘Wir eine Familie’ অর্থাৎ আমরা একই পরিবারের, তাই যাবোও এক সাথে। গার্ডের সম্মতিক্রমে ওরা এগিয়ে গেলো নির্দিষ্ট ঘরের দিকে।

ঘরে ঢুকতেই ওদের স্বাগত জানালো একজন মধ্যবয়স্কা নার্স। সুখেন্দুর স্বপ্নের “মেমবেশী উর্বশী” -র সাথে যার কোনো মিল নেই। কিন্তু ভদ্রমহিলার হাসিটি বড় চমৎকার। প্রাথমিক  আলাপচারিতার পর ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন, কে আগে নেবে। ইলোরা সুখেন্দুর দিকে তাকাতেই কোনো চান্স নিলো না সুখেন্দু। ‘তুমি আগে নাও’ বলেই গোলকিকে কোলে  নিয়ে  পাশে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়লো।  

নার্স মহিলা টিকা দেবার প্রস্তুতি নেবার সাথে সাথে ইলোরার সাথে কথা চালিয়ে গেলেন।  ওই দৃশ্য দেখবে না বলেই সুখেন্দু গোলকির সাথে মৃদু স্বরে কথা বলতে আরম্ভ করলো। দেখবো  না দেখবো না করেও মাঝে মাঝে দেখছে ওদিকে। গোলকিকে কোলের কাছে নিয়ে একটু জোরেই আঁকড়ে আছে।  “আর ইউ রেডি” শোনা মাত্র ভিতরটা একটু কেঁপে উঠলো। সেই  কম্পন বোধয় গোলকির কাছেও পৌঁছলো। ওর ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে সুখেন্দুর  চোখ ঢেকে বললো ‘বাবা তুমি দেখো না, চোখ বুঁজে থাকো।’ মৃদু হেসে সুখেন্দু বললো ‘ঠিক আছে, এই আমি চোখ বন্ধ করলাম।’

বন্ধ চোখ খুললো ইলোরার ‘হয়ে গেছে আমার’ ডাকে। গোলকিকে কোল থেকে সরিয়ে সুখেন্দু গিয়ে বসলো নির্দিষ্ট চেয়ারে। 

-I hope you know that today we are having Moderna vaccine. Are you agree to take that ?

– yes Maam .

– In which hand would you like to take vaccine today ? left or right ?

সুখেন্দুর মনে হলো যেন বলির আগেই পাঁঠাকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, কোন দিকে মুখ করে কাটলে তার সুবিধে হবে। পাঁঠার গলা একটা, তার হাত দুটো, তাই প্রশ্নের ভঙ্গিটা আলাদা। তবে নার্স মহিলা যে দিকে আছেন বাঁহাতটা হলেই সুবিধে।  ইলোরাও ওই হাতেই নিয়েছে।  তাই সুখেন্দুও ওই বাঁহাতে নিতে সম্মত হলো। 

এর পর নার্স মহিলা খানিকটা ক্ষমাপ্রার্থিনীর মতো জানালেন, আগের ব্যাচের শেষ টিকাটি  ইলোরাকে দেওয়া হয়েছে।  যেহেতু এখন শেষবেলা, তাই একটা ব্যাচ খুলে সব কটা  ঘরে  দেওয়া হবে যাতে সব থেকে কম সংখ্যক টিকা নষ্ট হয়। তিনি আশা করছেন, ২-৩ মিনিটের মধ্যে টিকা এসে যাবে। 

আসলে ফ্রীজার থেকে টিকা বার করে আনলে তাকে খুব তাড়াতাড়ি ব্যবহার করে ফেলতে হয়। এটা সুখেন্দুও জানে, কিন্তু এখন তার কোনো যুক্তিবুদ্ধি মানতে ইচ্ছে করছে না। সে  মনে মনে ভাবলো, ‘ওফ, এটা আজ আমার সাথেই হতে হলো?’ মুখে বললো ‘কাইনে প্রবলেমা।’

এই সাময়িক বিরতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে, ভদ্রমহিলা সুইস জার্মানে গোলকির সাথে কথা বলতে আরম্ভ করলেন।  গোলকি নিজের পরিবারের চৌহদ্দির বাইরে খুবই মুখচোরা। তার  ওপর একেবারে সদ্য শিখতে শুরু করা জার্মান ভাষায় কথা বলাটা ওরে কাছে আর একটা বাধা।  তাই ভদ্রমহিলাকে জার্মান আর ইংলিশ মিশিয়ে আলাপচারিতা চালিয়ে যেতে হলো।  

ইতিমধ্যে পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত, কিন্তু টিকার পাত্তা নেই। ভদ্রমহিলা উঠে এবার দেখে আসলেন। তাতেও বিশেষ লাভ হলো না।  আরো বেশ কিছুক্ষন সময় গেলো। ভদ্রমহিলা  যারপরোনাস্তি  বিব্রত হয়ে ইতি মধ্যে বার কয়েক ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। এই অবকাশে ইলোরার সাথে ওনার আলাপচারিতা জমে উঠেছে। দুজন মহিলা কি সুযোগের  সদ্ব্যবহার  না করে পারেন !

এই বাজে বকবক সুখেন্দুর এই সময় অসহ্য লাগছে। ২ মিনিটের জায়গায় ১০ মিনিট হয়ে গেলো, কিন্তু টিকার টিকিটি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এইখানে কোনো শেতাঙ্গ সুইস থাকলে  এতক্ষনে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতো নির্ঘাত।  হয়তো নিজেই উঠে কোল্ড স্টোরেজ থেকে টিকা আনতে যেতো। ভেতো বাঙালী সুখেন্দুর না আছে সে মুরোদ না সেই মানসিক বল। অতএব  অপেক্ষাতেই একমাত্র মোক্ষ।  

অবশেষে ভদ্রমহিলা একটা হেস্তনেস্ত করার ভঙ্গিতে বাইরে গেলেন। বাইরে কারুর সাথে কথাবার্তা বলতেও শোনা গেলো। শব্দ শোনা গেলোও তার অর্থ বোঝার সাধ্য নেই। প্রায় সঙ্গে  সঙ্গেই ফিরে এলেন, হাতে একটা ছোট প্যাকেট। আমাদের  জানালেন, টিকার প্যাকেট নাকি তাকে না জানিয়েই বাইরে রেখে দিয়ে গেছিলো। মহিলার বডি ল্যাঙ্গুয়েজে স্পষ্টত অসন্তোষ।  

টিকার জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি এবং আর এক প্রস্থ ক্ষমা প্রার্থনা করে, মহিলা সুখেন্দুকে বললেন, ‘ফাইনালি, আর ইউ রেডি।’ সুখেন্দু গলা থেকে আওয়াজ বেরোলো না, শুধু ঘাড়  নেড়ে  হ্যাঁ বললো।

কিছু বোঝার আগেই সুখেন্দুর টিকা নেওয়া হয়ে গেলো। নার্স মহিলার আজ সুখেন্দুই শেষ পেশেন্ট, তাই বোধহয় উনি অনেকটাই হালকা। ইলোরার সাথে আরেক প্রস্থ  গল্প ফাঁদতে  যাচ্ছিলেন, কিন্তু সুখেন্দুর ছটফটানি দেখে উনি বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে সে ইচ্ছার ইতি ঘটালেন। 

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা থেকেই চলে যেতে চায় সুখেন্দু। ভদ্রমহিলা বলে দিলেন, ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আর একটা কাউন্টারে গিয়ে কাগজপত্র জমা দিতে। সেইমতো কাগজপত্র  জমা দিয়ে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট এর জন্য রেজিস্টারও করলো ওরা। এই সার্টিফিকেট হয়তো কাজে লাগবে ভবিষ্যতের ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলে। ওই কাউন্টার থেকেই বললো, সামনের  প্রতীক্ষালয়ে আরো ১০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে তবে বাড়ি যেতে।   

বাইরে যাবার রাস্তার পথেই প্রতীক্ষালয়।  সুখেন্দুর মনে হলো, এতক্ষনে একটু শান্তি।  ইলোরাকে বললো, ‘জলটা দাও, তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে।’ জল খেয়ে সত্যিই যেন প্রাণ ফিরে  পেলো সুখেন্দু।  যদিও এই ১০ মিনিট বসে যাবার ব্যাপারটা ওরে মাথায় ঢুকলো না। ১০ মিনিট বসে যে কি হবে ভগাই জানে ! খেলতো শুরু হবে কয়েক ঘন্টা বাদে।   

                                                                                                        ~~~~~ : ~~~~~~

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো সুখেন্দুর।  খুব তেষ্টা পেয়েছে। একটু ঠান্ডাও লাগছে।  পাতলা চাদরে শীত আটকাচ্ছেনা।  সামনের দেওয়াল ঘড়িতে দেখলো রাত ১২টা । পাশে রাখা জলের  বোতলটা নিতে গিয়ে দেখলো মাথাটা প্রচন্ড ভার, প্রায় তুলতেই পাচ্ছে না। মানে তিনি এসে গেছেন।  

টয়লেটে যেতে গিয়ে বুঝলো গোটা শরীর টলমল করছে। হাতে জল পড়তেই শরীরের ভিতর কেমন যেন কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। তাড়াতাড়ি এসে বিছানায় শুয়ে পড়লোও। শুতেই মনে  হলো শরীরের মধ্যে প্রবল ঝড় উঠেছে। 

ইলোরাও জেগে উঠেছে। দুর্বল গলায় বললো ‘জ্বর আসলো নাকি তোমার? আমারতো খুব শীত করছে – ২টো কম্বল চাপিয়েছি। তুমি ওই মোটা কম্বলটা নাও। দেখো পায়ের কাছে  রাখা  আছে।’

বিনাবাক্যব্যয়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লো সুখেন্দু। মোটা কম্বলেও যেন শীত যাচ্ছে না। ঘুম আসছে খুব, কিন্তু ঘুমাতে পাচ্ছে না। এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো।  

একটু পরে  হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো – টয়লেট যেতে হবে।  মাতালের মতো নড়তে নড়তে টয়লেট গেলো ।  ফিরে এসে আবার জল খেয়ে শুয়ে পড়লো সুখেন্দু। এই হয়েছে এক কান্ড ! ঘন ঘন জল খাও, আর টয়লেট যাও – ঘুমের একেবারে বারোটা। কি যে আছে ছাই এই টিকাতে ! কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে কাটছে। 

ভোররাত্রির দিকে হঠাৎ যেন শরীরের ভিতরে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। তারপর শুরু হলো উথালপাথাল।   

সারা শরীরে যেন একটা ঠান্ডা ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে। কখনো বুক কাঁপাচ্ছে, কখনো হাত, কখনো পা। কম্পনের প্রকোপ কমাতে শরীরটাকে একবারে ছোট করে কুঁকড়ে আছে সুখেন্দু, তবু কিছুতেই থামছে না এই শরীর জুড়ে উন্মাদনা। 

কয়েক মুহূর্তে সুখেন্দু ভুলে গেলো সে কোথায় আছে – সুইজারল্যান্ড, কলকাতা, বেঙ্গালুরু, হিউস্টন – সারা জীবনে সে যত জায়গায় থেকেছে,  ঘুরপাক খেতে লাগলো সেই সব জায়গায়। কোথাও সে থামতে পারছে না। মনে হলো একটা ঢেঁকি চড়ে সে ব্রহ্মান্ড দর্শন করছে। মাঝে মাঝেই ঢেঁকিটা গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে ব্রহ্মান্ডের দেয়ালে,  আর দিক পরিবর্তন করে সে গিয়ে  পড়ছে আর একটা নতুন জায়গাতে। স্থান কাল পাত্র সব গুলিয়ে যাচ্ছে এই প্রবল ঘুরপাকে। কিছুক্ষন পর ভালো করে তাকিলে দেখলো ঢেঁকিটার দিকে – এটাতো ঠিক ঢেঁকি না, মাথার  দিকটা কেমন ছুঁচালো।  ঘাড় ঘুড়িয়ে পিছনটা দেখলো – এতো কেমন একটা রকেটের মতো – না না এর গায়ে কি রকম স্কেল এর মতো দাগ কাটা।  ওফফ কি প্রবল বেগে ছুটছে ! প্রানপনে আঁকড়ে ধরে বসে আছে, নাহলে যে পড়ে যাবে ও।  এতো জোরে যাচ্ছে যে ভালো করে দেখতেও পাচ্ছে না এটা ঠিক কি জিনিস।

 ভালো করে দেখলো, আশপাশের অনেকেই ওর মতো ঘুরছে। কিন্তু কারা এরা?  কিছু বোঝার আগেই তারা হুশ করে বেরিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে! চিৎকার করে সে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তোমরা জানো এটা কি? কেউ বলতে পারবে?’ তার কথাগুলো ওই ব্রহ্মান্ডের গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো।  কেউ কি শুনতে পেলো তার কথা ? কেউ কি উত্তর দিলো ?

হঠাৎ কোথা থেকে এক রাশ সাদা সাদা মেঘ এসে ভিড় করলো।  সেই সব মেঘেরা কেউ মাথা, কেউ পেট, কেউ বুক, কেউ হাত কেউবা পা – চারিদিকে ঘুরপাক খেতে লাগলো। এরমধ্যে  একটা প্রকান্ড মাথা মেঘ তার একেবারে কাছে এসে গেলো। গোল্লা গোল্লা চোখ দুটো তার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার দ্রুত চোখের পাতা ফেললো। ঠোঁটদুটো খুলে গেলো পাপড়ির মতো।  কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো ‘এটা একটা সিরিঞ্জ – তুমি চেপে আছো অথচ তুমি জানো না, আশ্চর্য ! এতক্ষন ধরে আমাদের পেছনে তাড়া করে বেড়াচ্ছো। ‘

– আমি তাড়া করে বেড়াচ্ছি ! বিশ্বাস করো আমি কিছুই জানিনা। এ আমাকে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু সিরিঞ্জ তোমাদের তাড়া করছে কেন ?

– আমরা ভ্যাকসিন নিতে চাই না। এটা পাজি ভ্যাকসিন।  

– কিন্তু ভ্যাকসিন না নিলে তোমাদের যে বিপদ।  

– কিছু বিপদ নেই। আমরাতো ভেসে বেড়াই। খেলে বেড়াই । রূপ বদল করি, শরীর বদল করি। রোগ আমাদের ছুঁতেই পারে না। শুধু শুধু আমাদের আকাশে এসে তোমরা ভয় ছড়াচ্ছ। ঐ যে ডাক পড়েছে  আমার – খেলার সময় শেষ, এবার ফিরতে হবে – আমি যাই …………

কথা বলতে বলতে দূরে চলে গেলো ওই মেঘ।  যাবার আগে কান ভিজিয়ে দিয়ে গেলো।  

মাথা মেঘ যে দিকে গেলো সেখানে এসে একে একে জড়ো হলো আর সবাই – হাত-পা-বুক-পেট সবাই। সে যেন এক বিরাট কর্মকান্ড। মুহূর্তের মধ্যে নাচতে নাচতে ওরা  সব এক হয়ে  একটা প্রকান্ড মানুষ হয়ে গেলো।

প্রবল বেগে নড়ে উঠলো সেই ঢেঁকি সদৃশ সিরিঞ্জ। তার শরীরের মধ্যের তরল ছলাৎছল করে উঠলো। তারপর হঠাৎ প্রানপন বেগে ছুটতে আরম্ভ করলো সে। ধেয়ে গেলো  ওই মেঘ  মানুষের দিকে। সুখেন্দু চিৎকার করে বললো ‘ওদের ছেড়ে দাও, ওরা চায় না – ওদের ছেড়ে দাও।’  ব্রহ্মান্ড জুড়ে সে কি তান্ডব  – যেন ভৈরব খেপেছে। এলোপাথাড়ি ছুটছে সবাই। সুখেন্দুর শেষ কথাগুলো ‘ওদের ছেড়ে দাও’ , ‘ওরা চায় না’ ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিধ্বনির মতো চারপাশে। 

হঠাৎ একটা হাত তাকে ধরে প্রচন্ড জোরে ঝাঁকুনি দিলো। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিলো মাটিতে। কয়েক পলক নিথর হয়ে থাকলো সে। চারিদিক নিস্তব্ধ।

 ঘোরের মধ্যে প্রলাপের মতো সে বলে উঠলো, ‘ঠিকই বলেছেন মা  – এ নির্ঘাত ম্যাডোনা টিকা – নাহলে এমন পাগলের নাচনকোঁদন করায় !’

পাশ থেকে ইলোরা আর একবার ধাক্কা দিয়ে বললো ‘পাশ ফিরে শোও, নাক ডাকছে খুব।’