– আমারে লিচে নামাই দে না ক্যানে, আমি পারবো বটে। 

– লা রে বিটিয়া, পাটরি, পাথর সব তাতাই ছে। তোর ছুটা ছুটা পায়ে ছিকা লাগিবে রে মা।  

– কিছু হবেক লাই।  আমার পায়েতো জুতাটো আছে।  

– সেতো আমার পায়ে টো  আছে। 

–  তুর জুতাটা টো ছিঁইড়া বটে। তোর কোষ্ট হৈছের রে বাপ।  

– শুনো বিটির কুথা। শুনচো মুনিয়ার মাই, বেটি টো বড় হয় গেলো বটে।  

 

শিবুর কোলে মুনিয়া – কোমরের কাছ বরাবর একটা কাপড় দিয়ে বাঁধা – মুনিয়ার মাথাটা শিবুর বুকের কাছে। হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে আছে।  শিবুর সামনে  সামনে হাঁটছে ওর বৌ সুমি আর ছেলে সুভাষ।  সবার পিঠে একটা করে কাপড়ের বোঁচকা।  শুধু শিবুর কাঁধে একটা ব্যাগ।  

 

শরীরটা কদিন ধরেই ভালো নেই মেয়েটার।  রাতের দিকে জ্বর আসছে রোজ।  চোখ দুটো ছলছল করছে সারাদিন।  জন্ম থেকেই ভুগছে মেয়েটা।  এই  মাঘে ৮ বছর হবে । শরীরটা সেই অনুপাতে বাড়ে নি,  কিন্তু বুদ্ধি খুব। 

 

পড়ন্ত বিকেলের রোদটা মুখে পড়ছে দেখে মুনিয়া শিবুর বুকের ভিতর মুখটা আরো গুঁজে দেয়।  তখনি তার মনে হলো, বুকের শব্দটা যেন বড্ড বেশি – হাপর যেন ঘন ঘন পড়ছে।  খুব কষ্ট হচ্ছে তার বাপের।    

 

আজ ৩ দিন হোলো হাঁটছে ওরা। যাচ্ছে রায়গড় জংশন।  ওরা চারটি পরিবার আর রিয়াজ । বিয়েসাদি করেনি রিয়াজ , কিন্তু জ্ঞান বুদ্ধি বেশি বলে ওকে   একপ্রকার সবাই মান্যি করে।  শিবু ছাড়া আর আছে  উত্তম, গিরিজা  আর  কেনকিরাম এর পরিবার।  জোয়ান বাচ্চা  মিলিয়ে  চোদ্দ জন।  

 

খবরটা প্রথম রেয়াজই দিয়েছিলো।  সন্ধেবেলা দৌড়ে এসে বললো, “রায়গড় জংশন সে ট্রেন চালু হচ্ছে । সরকার বাহাদুর মজদুর লোগোকি ঘর ওয়াপসির  জন্য ট্রেন দিচ্ছে। হপ্তে মে দো দিন মঙ্গল আর শুক্কুর আমাদের ট্রেন -বাঙ্গাল  বিহার যাবে।  আজ সোমবার –  কাল সুবহে সুবহে যদি নিকালতে  পারি শুক্কুর বারের ট্রেনটা  পাকাড়তে পারবো।  রাতের মধ্যে সব  সমান-ওমান গুছিয়ে লাও। “

 

যদিও রিয়াজ হিন্দিভাষী , কিন্তু কয়েকবছর  সে কোলকাতায় কাজ করেছে ,তাই একটু একটু বাংলা সে বলতে পারে ।  শিবুর সাথে কথা বলার সময়  তাই হিন্দির মধ্যে বাংলা মিশিয়ে দেয়,  যাতে শিবুর বুঝতে সুবিধে হয়।  এখানে থাকতে থাকতে শিবুও হিন্দিটা এখন মোটামুটি বুঝতে পারে। কিন্তু  বলতে সেভাবে পারে না।  

 

প্রথমটা একরকম ঘাবড়েই গেছিলো শিবু।  পাশেই ছিল সুমি।  ওরা দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো। ব্যাপারটা আন্দাজ করে রিয়াজ বললো,  

 জাদা  সোচতা  কিউ ?  কুছ  দিন পরে  বস্তিতে কোউন থাকবে ?  স্রেফ ইয়ে হাম কুছ ভিন গাও কি লোগ ইহা হ্যায়।  কাম নেহি , খানা নেহি।  ফ্যাক্টরি  কব্ খুলেগি কোয়ি পতা নাহি।  নিজের গাঁও গেলে কুছ না কুছ  করতে পারবে। 

– কিন্তু রিয়াজ ভাই,  ইতনা কম সময়মে … মানে ইতনা কুছ গুছানা …..

– আরে ক্যা গুছানা হয়? আপনা গদ্দা , বরতন  থোড়াই লেনা হয় !  এতোটা পথ পায়দল যেতে হোবে – সামান জিতনা কম, উতনাহী আচ্ছা।  কুছু  বুঝতে পারলে ?     

– লেকিন এই আমার ঘর? এসব মালপত্র ?

– সবাই যেরোকোম গেছে , তুমলোগ ভি  আইসা করো।  তালা লাগাকে যাও। হামভি আইসাহি কর রাহা হ্যায় । ফ্যাক্টরির সামনে আছে, চোরি -ওরি  কুছ নাহি হোগা।  দারোয়ান লোগকো সব বাতাকে যা রাহে হাম।  আর চিন্তা কোরো না শিবু দাদা , আমিতো আছি।  ম্যানেজার বাবু কো হাম   হার   হপ্তা ফোন করেঙ্গে।  ফ্যাক্টরি খুলার খবর হলেই সোবাইকে আমি জানিয়ে দেবো।  জিন্দা রেহেঙ্গে তব না সামান কি জরুরত পড়েগি। অভি ম্যায় যাতা হু।  বহত কাম বাকি।  উত্তম, কেনকি, গিরি  উন সভি লোগোকো খবর করনা হ্যায়।  মুঝেভিতো তৈয়ার হন হ্যায়।  কাল সোকালে ছটার সময়  ফ্যাক্টরি  গেটের সামনে আ যানা।    

 

যেমন  ঝড়ের মতো এলো, তেমনি তুফানের মতো বেরিয়ে গেলো রিয়াজ।  কিছুক্ষন থম মেরে বসে রইলো শিবু।  সুমির মুখেও কোনো কথা নেই।  চোখদুটো শুধু জলে ভরে যাচ্ছে।  মুনিয়া শুয়ে ছিল সামনেই।  আজকাল সন্ধের পর থেকেই একটু ঝিমিয়ে পড়ে ও। ছেলেটা বাইরে খেলছে।  

 

বেশ কিছুক্ষন থম মেরে বসেছিলো ওরা।  মাঝে মাঝে শিবু সুর কেটে কেটে কথা বলছিলো প্রলাপ বকার মতো।  

– কুথা থিকা কি সোব হুয়ে গেলো বোলতো।  পাপে পিথিবি টো ভুরে গেছে বোটে।  নৈলে ই রোগ আসলো কুথা থিকা। শুনছে কেউ আগে ? ভূরাস না কি ।  

শুয়ে শুয়েই মুনিয়া বললো – ভূরাস না বাপ , উটা ভাইরাস বোটে।    

– হা হা ভিরাস। মানুষ মুরছে মোশা মাছির মুতো।  কাম নাই, খানা নাই, দানা নাই।  ভিবেছিলাম এ বছোর জল আসার আগে চালটো ঠিক কুরবো। কুথা কি !  ফেক্টরি বোন্ধ – কাম কাজ নাই।  

সুমি  হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো –

– রিয়াজ দাদা ঠিক বলছে বোটে, প্রাণঠো থাকবে তবেই না সোব। ইখানে বুসে থিকা কুনো লাভ নাই। দিশে গিলে কিছু একটো হবে।  উঠো উঠো, সময় বেশি লাই, সব গুছিয়ে লিতে হোবে।  

 

অনেক রাত অবধি শিবু আর সুমি সব গুছিয়ে রাখলো।  ছেলেমেয়ে দুটো অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।  সুমির চোখ মাঝে মাঝেই জলে ভরে যাচ্ছে।   গত পাঁচ বছরের সংসার। নিজে হাতে একটু একটু করে কিনেছে সব। এক একটা জিনিস হাতে তুলতেই ভেসে উঠছে স্মৃতি – খুব যত্ন করে কোথায়  যেন রাখা ছিল।  বুকের ভিতরটা কেমন জানি মুচড়ে মুচড়ে উঠছে।  

 

পরেরদিন কাকভোরে ফ্যাক্টরির গেট।  ওরা পৌঁছতেই দেখলো বাকি সবাই এসে গেছে । চোখেমুখে সবারই  খানিক আতঙ্ক, খানিক দুঃখ।  একদিকে   অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর চিন্তা , অন্যদিকে এতদিনের  ঘরদোর সংসার ছেড়ে যাবার কষ্ট।  

 

সেই চলার শুরু।  আজ নিয়ে ৩ দিন।  মাঝে মাঝে দিনের বেলা একটু করে বিশ্রাম, তারপর আবার চলা।  প্রথমদিন একটা মন্দিরের চাতালে শুয়েছিলো রাতে। পরেরদিন এক বড়োমানুষের বাড়ির উঠোনে। কবেলা পরে সবার পেটে একটু ভাত পড়েছিল গতকাল রাতে। ওই বড়োমানুষের বাড়ির থেকে দিয়েছিলো  ওদের।  নইলে ২দিন শুধু চিড়ে মুড়ি বা ছাতু – যার সঙ্গে যা ছিল। 

 

ছেলে মেয়েগুলো সত্যি আর হাঁটতে পারছেনা।  কিন্তু রিয়াজ সবাইকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে । ” চালো চলো জলদি জলদি – শুক্কুরবার কি টেরেন  ছুট  জায়গি তো তিন  দিন ইস্টিশন মে রহেনা পড়েগা। বহুত মুসিবত মে ফাস জায়েঙ্গে । ”    

 

এর মধ্যে পথে ২ বার পুলিশ আটকে ছিলো। রিয়াজ ই কথাবার্তা বলে পুলিশের ঝামেলা সামলে দিলো।    

 

দুদিন অনেকটাই হেঁটেছে মুনিয়া। কিন্তু আজ সকাল থেকে মোটেই পারছে না।  রাতের দিকে কালও জ্বর এসেছিলো। মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে একটা হাত  বাবার বুকের উপর রেখে শুয়েছিল মুনিয়া।  এই ছেঁকছেঁকে হাতের ছোঁয়াতেই শিবু বুঝতে পারে মেয়ের জ্বর এসেছে।  অনেকরাত অবধি মেয়ের মুখের  দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল সে।  ভেবেছিলো মেয়ে ঘুমোচ্ছে।  হঠাৎ ক্ষীণস্বরে মুনিয়া বলে উঠলো – আমার জ্বর ঠো হলে তুর খুব কষ্ট হয় লা রে বাপ।  দেখিস  আমি ঠিক ভালো হুয়ে যাবো রে।  আর জ্বর আসবেক লাই।  তুই ঘুমাই লে।  

 

বুকের ভিতরটা ঠেলে কান্না এসে গেলো শিবুর।  চোখ বুঁজে অন্যদিকে ফিরে শুলো সে ।  মেয়েটা বড় বুঝদার।  চোখের জল দেখলে অকারণ কষ্ট  পাবে।   

 

মুনিয়া যে হাঁটতে পারছেনা সেটা রিয়াজও লক্ষ্য করেছে।  নিজেই এগিয়ে এসে বললো – শিবু দাদা, তোমার পিঠের সামান ঠা হামাকে দাও, অউর তুমি  বিটিয়া কো গোদ মে লিয়ে লাও।  

 

শিবু আপত্তি করেনি।  সেই থেকে মুনিয়াকে কোলে নিয়েই হাঁটছে সে।  বাবার কষ্ট হচ্ছে দেখে মেয়ে আবার নিচে নেমে হাঁটতে চায়।  কিন্তু শিবু  মনে মনে  ঠিক করেছে, শত কষ্ট হলেও এই শেষবেলা সে মেয়েকে  হাঁটতে দেবে না।   

 

 আজ দুপুরবেলা সামনে রেল লাইন দেখে সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলো।  সূয্যি তখন মাথার ওপর।  রেল লাইন দেখে ওদের মনে হয়েছিল, এসে গেছে  ওদের গন্তব্য।  কিন্তু রিয়াজ বললো এখনো অনেকটা পথ। তবে এই ভাবে হাঁটতে থাকলে নাকি সকালের মধ্যে পৌঁছে যাবে ওরা।  লাইন ধরে চললে পথ  ভুল করার ভয়ও থাকে না।  তবে আজ রাত্তিরে ঘুমোনো চলবেনা।  একেবারে ট্রেনে চেপে তবে ঘুম।  

 

তাই সেই তখন থেকে এই পর্যন্ত একবারও থামেনি ওরা।  মাথার ওপর গনগনে সূর্য আর পায়ের তলায় তেতে ওঠা লোহার লাইন আর পাথর। তার মাঝখানে  কেমন যেন একটা নেশায় ধরে চলেছে সবাই।    

 

এখন পড়ন্ত বিকেল, সূর্য ডুবু ডুবু করছে।  এসব পাহাড়ী অঞ্চলে আবার সূর্য ডুবলে  ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে।  তবে আজকালের মধ্যেই বোধহয়  পূর্ণিমা, তাই রেল লাইন ধরে পথ চলতে অসুবিধে হবে না বোধহয়।    

 

একটু পরেই সূর্য ডুবে গেলো। চাঁদের আলোয় রেল লাইনের পথ ধরে চলতে থাকলো ওরা।  ক্লান্ত পা যেন চলতেই চাইছে না। পায়ে পায়ে ধাক্কা খাওয়া  পাথরের আওয়াজ ই যেন একমাত্র প্রমান যে ওরা বেঁচে আছে ।  মাঝে মাঝেই রিয়াজ তার হাতের লাঠিটা দিয়ে রেল লাইনে সজোরে মারছে। নিস্তব্ধ  প্রান্তরে সেই আওয়াজ খানখান হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। তার মাঝে কানে বাজছে ঘন ঘন নিঃশ্বাস আর বুকের ওঠানামার শব্দ।  

 

কেনকিরাম ই প্রথম মুখ খুললো।  হঠাৎ দাঁড়িয়ে পরে বললো – রিয়াজ ভাই, অর নেহি হোতা।  বাচ্চে লোগোকা  হাল দেখা নাহি যাতা।  অব তানিক  বৈঠতে হ্যায়।  থোড়ি বিস্রাম করকে, পানি-ওয়ানি পিকে তব যাতে হ্যায়।  

 

এ যেন সকলেরই মনের কথা, কিন্তু কেউ আর মুখ ফুটে রিয়াজকে বলতে পারছিলো না।  রিয়াজও আপত্তি করলো না।  শুধু বললো – একবার বৈঠ গেয়ে      তো  উঠনা মুশকিল হো  যাতা হ্যায়।  স্রেফ আধা ঘান্টা  বৈঠেঙ্গে, উসকে বাদ সিধে জাংশান – বিচমে কাঁহি রোকেঙ্গে নাহি।    

 

রিয়াজ বলামাত্রই রেল লাইনের ওপর যে যার ব্যাগ, পোঁটলা রেখে বসে পড়লো।  কিছুক্ষনের জন্য হলেও  সবাই প্রায় শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে বসলো।  

 

শিবু সুমি কে বললো – বাচ্ছাদের পাশে তুইও শুয়ে পড় না কেনে। অলেক টা পথ যেতে হবে বটে। আমিও বিটিয়ার ইধারে শু ছি।  কোমরটা টাটাইছে বড়ো। একটু না ছাড়লেতো মুশকিল হবে খুব।  

 

রিয়াজ বসলো একটু তফাতে।  ব্যাগের ভেতর থেকে  একটা ছোট বোতল বার করে মাঝে মাঝে চুমুক দিয়ে খেতে লাগলো। বোধহয় এ অঞ্চলের দিশি মদ।  কাল সন্ধেবেলা গাঁয়ের এক চাষাকে সঙ্গে নিয়ে কিনতে গেছিলো, ফিরেছিলো অনেক রাতে।  কালকের বোতলের কিছুটা হয়তো আজ আছে।  শিবু দেখলো, কিছুক্ষন পর উত্তম আর গিরিজাও জুটেছে সেখানে। বস্তিতেও নেশার ব্যাপারে রিয়াজের সাগরেদ ছিল এরা  দুজন।           

 

– বাপ , আমার বই টো দে না কেনে।  

বই মানে একখানা চটি ছবির বই।  রূপকথার গল্প।  ওদের বস্তিতেই ছাগুলালের পুরোনো লোহালক্কড়, কাগজ , প্লাসিক এসবের দোকান।  একদিন  সেখানেই এই বাংলা বইটা শিবুর চোখে পড়েছিল।  মুনিয়ার জন্য কিনতে চাইলে, ছাগুলাল বিনি পয়সাটাই ওকে দিয়েছিলো ওটা।  

 

সে বই পেয়ে মুনিয়ার সে কি খুশি ! সেই থেকে এই বইটা মুনিয়ার সদা সঙ্গী।  প্রথম প্রথম সুমি ই ওকে  ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে গল্প পড়ে শোনাতো। কদিন  পর থেকে প্রত্যেক রাতে ওই একই গল্প বলে ঘুম পাড়ানোটা একটা অভ্যেস হয়ে দাঁড়ালো।  

 

শিবু ব্যাগ থেকে বইটা বার করে মুনিয়ার হাতে দিতেই, ও ওটাকে বুকে চেপে আর একটু মায়ের কোল ঘেঁষে শুলো।  ও পাশে সুভাষ দুটো পোঁটলাকে  জড়ো করে তার উপর শুয়ে আছে।  

 

এক একটা পরিবার একটা অঞ্চল ঘিরে শুয়ে।  সবাই প্রায় আধশোয়া বা পুরোশোয়া।  এই অদ্ভুত নিঃস্তব্দতা যেন সময়কে গিলে ফেলেছে। এক মুহূর্ত  কাটলো, না এক প্রহর বোঝার উপায় নেই।      

 

~~: ~~

 

আজ আকাশে চাঁদের হাট। জোসনা লুটোপুটি খাচ্ছে গাছে গাছে , প্রান্তরে, এমনকি এই রেলের পাটরীতেও।  মুনিয়ার চোখে আজ ঘুম নেই। শুয়ে শুয়ে  সে আকাশ দেখছে। সেখানে সাদা মেঘেরা খেলা করছে চাঁদের দেশে।  ভারি মজা লাগছে শুয়ে শুয়ে দেখতে।  ওই দেখো কেমন একটা  ছোট্ট  খরগোশ বেরিয়ে এলো ওখান থেকে।  কেমন ভাসতে ভাসতে হঠাৎ হয়ে গেলো ময়ূর – কেমন পেখম মেলে নাচছে।  

– এই মাই, রাজপুত্তুর ওই চাঁন্দের দেশ থিকে আসবে বটে, নাই ? আই  মাই।  

দুচারবার ডেকে সারা পেলো না মুনিয়া। মায়ের বুকের ওঠানামা দেখে বুঝলো মা ঘুমিয়ে পড়েছে।  ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো বাবাও পাশ ফিরে শুয়ে আছে।     

– এই বাপ , দেখনা কেনে , বাপ এই বাপ। 

 

আবারো সাড়া পায়না মুনিয়া।  হাতের বইটা বুকের কাছে  আরো জোরে আঁকড়ে ধরে।  ক্লান্ত অলস চোখ, তবু রূপকথা ভিড় করে আসে।  সে ঠিক জানে  ওই চাঁদের পথেই দেখা দেবে রাজপুত্তুর।  সেই যে লম্বা কালো চুলের রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে সাতসমুদ্দুর, তেরো নদী পেরিয়ে পক্ষিরাজে চেপে  আসে সে।  রাতে শুয়ে শুয়ে কতবার মা তাকে গল্পটা বলেছে।  যতবার তার মা এই গল্পটা বলে, কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ে বুঝতেই পারেনা।  কিছুতেই  তার শেষটা কোনোদিন শোনা হয়না।  আজ ভাবলো সে শেষটা শুনবে, কিন্তু দ্যাখো মাই, বাপ , দাদা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।

 

রেল লাইনের নিচ থেকে এখনো গরম উঠছে  উপরে।  মা-র বুকটা কিন্তু খুব ঠান্ডা।  সেখানে খানিকটা মুখ গুঁজে একটা চোখ তুলে চাঁদের পথের  দেখে চেয়ে থাকতে থাকতে কখন ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো মুনিয়া   – রূপকথার দেশে – দু চোখের আবেশে তার স্বপ্নের রাজকন্যার ছোঁয়া।  ঐতো  পাতার আড়ালে গাছের ডালে বসে বেঙ্গমা গল্প শোনাচ্ছে  বেঙ্গমীকে –

” ….তখন ডাইনি বুড়ি রাজকন্যাকে তার জাদুর বশে ঘুম পাড়িয়ে রওনা হলো তার মেয়ের বাড়ি দিকে  – হাজার যোজন দূরে পাতালপুরীতে।  রাজকন্যার  ঘুম একমাত্র ভাঙতে পারে সোনার কাঠি রুপোর কাঠির ছোঁয়াতে।  কিন্তু সেওতো রাখা আছে মারণকূপের ভিতর এক অজগরের পেটে।  রাজপুত্তুর  একমাত্র পারে সেই সোনার কাঠি রুপোর কাঠি উদ্ধার করতে।  কিন্তু কোথায় সেই রাজপুত্তুর! জাদু ঘুমের মধ্যেও রাজকন্যা থেকে থেকে ডাকছে – কোথায় তুমি , কোথায় তুমি দুধকুমার – আমাকে মুক্ত করো, নিয়ে চলো তোমার সাথে………..”     

 

নিস্তব্ধ নিথর এই প্রান্তর।  আশপাশে কোনো জনবসতি নেই।  বহু দূরে কোথাও বা হালকা আলো দুএকটা আলো বিন্দুর মতো কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। হঠাৎ ই ঘুম ভেঙে যায় মুনিয়ার। কে যেন আসছে দূর থেকে।  মাটির বুকে তারই স্পন্দন।  রেল লাইনের পাথর , কাঠ সবই যেন কাঁপছে।   কে আসছে ? রোজ রাতে তার এইসময় জ্বর আসে। একটু একটু ঠান্ডা লাগছে বটে , কিন্তু এটাতো তার শরীরের কাঁপুনি নয়।  চোখটা খুলতে ভয় করছে। তবু আস্তে  আস্তে চোখ খুললো মুনিয়া। ওমা – চাঁদের গা বেয়ে একটা লম্বা সাদা পথ কতদূর নেমে গেছে।

  তবে কি তার রাজপুত্র চাঁদের দেশ থেকে ওই পথেই নেমে এসেছে পৃথিবীতে – পক্ষিরাজের পিঠে চড়ে ? পক্ষিরাজ কি এখন মাটিতে ? তারই পায়ের  শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে !

– মাই ও মাই – বাপ হেই বাপ – দ্যাখনা কেনে – রাজপুততুর আইছে। 

গলা দিয়ে তেমন আওয়াজ বেরোয় না মুনিয়ার। হাত দিয়ে  হালকা ধাক্কা মারে তার মাকে। সাড়া পায়না।  

 

শুধু মুনিয়ার বাবা মা নয়, সাড়া দেবার মতো অবস্থায় তখন কেউ নেই  – সবাই গভীর ঘুমে অচেতন।  এমন কেউ নেই যে সকলকে জাগিয়ে বলে – ওঠো , আমাদের যেতে যেতে হবে – আধঘন্টার বিশ্রাম হয়ে গেছে।  

 

আসলে ইতিমধ্যে কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা।  এখন মধ্যরাত।  

 

হঠাৎ কেমন ভয় করে মুনিয়ার।  মনে হচ্ছে এদিকেই  আসছে রাজপুততুর।  মাটির কাঁপুনি যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে।  চোখ বুঁজে কান পেতে শুনতে  চেষ্টা করলো সে।  এমনি করে কি পক্ষিরাজ আসে !  তার ভয় করছে কেন ? মায়ের বুকের আরো গভীরে ঢুকে যায় মুনিয়া। না না, সে শুনতে চায় না। মাটির কাঁপুনি যে বেড়েই চলেছে। 

 

হঠাৎ ই দূর থেকে ভেসে আসে একটা ভোঁ ভোঁ আওয়াজ।  রাতের বুক চিরে আর্তনাদের মতো।  ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে মুনিয়ার।  তার মা তাকে শিখিয়েছে,  ভয় হলেই ঠাকুরকে ডাকতে।  প্রানপনে সে দুটো হাত জোর করে ঠাকুরকে ডাকতে লাগলো।  ঠাকুরের মুখটা কেমন যেন অস্পষ্ট, আবছা।  তবে সে  প্রানপণ চেষ্টা করতে লাগলো।  

 

 একটু একটু করে চোখ খুললো মুনিয়া।  ভোঁওওওওওওও – ভোঁওওওওওওও।  আবারো রাতের বুক চিরে আর্তনাদ।  কিন্তু সে চিৎকারেও ঘুম ভাঙ্গেনা  অন্য কারো।  একা একাই  যুদ্ধ করে ছোট্ট  মেয়েটা। শরীরের তাপমানের সাথে সাথে যার ছোট্ট মনেও বেড়ে চলেছে উত্তেজনা – প্রতিক্ষণে – প্রতিনিশ্বাসে।

 

অন্ধকারের বুকে চিরে এই আলো, এই ভোঁ শব্দ কিসের ? তবে কি তাঁদের রেলগাড়ি এসে গেলো !  নাকি এসে গেলো তার রাজপুত্তুর !  ছোট্ট বুকে  চলতে থাকে  উথালপাতাল।  

 

ওদিকে অনতিদূরে  অযুত লৌহদানবের  দম্ভ নিয়ে রাতের বুক চিরে ছুটে আসছে এক মত্ত “শ্রমিক স্পেশাল ” – তার সামনে পাথর বিছানো একজোড়া লাইন – যার শেষ দেখা যাচ্ছে না  – চাঁদের আলোয় তার পাঁজরগুলো যাচ্ছে গোনা ।  তারই মাঝে শুয়ে আছে ক্লান্ত নিঃশেষিত অসহায় কিছু মানুষ – একখন্ড ভারতবর্ষ – পরিযায়ী ভারতবর্ষ।  আর শুয়ে, রূপকথার সেই  রাজকন্যা  –  যার ঘুম ভাঙবে সোনার কাঠি রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় –  বুঝি এই পথেই আসবে তার রাজপুত্তুর – পক্ষিরাজে চেপে ।  

 

                                                           ~~~~~~~~~~~ ::: ~~~~~~~~~~~~

 

[ সুধী পাঠক – আমি আমার সর্বশক্তি দিয়ে প্রানপনে আটকাতে চেয়েছি ওই লৌহদানব কে – তার গতিপথে দাঁড়িয়ে তার পরাক্রমকে বশীভূত করতে।  কিন্তু না, আমি পারিনি। আমি  অসহায় ।   

 

লেখকেরা সর্বশক্তিমান হয় না।  লেখক তাঁর কলমের আঁচড়ে গল্পের অভিমুখ বদলে দিতে পারে, কিন্তু ভবিতব্য ?  না, ভবিতব্য বদলে দিতে পারে না  লেখক ।  একটা গোটা জাতির নিয়তি পরিবর্তন করতে পারে শুধু জনগনেশ – তার উত্থান ।  জনাদেশের সেই বিপ্লবে প্রধান যোদ্ধা সেই পক্ষিরাজ – যে লক্ষ  অশ্বশক্তির বলে বলীয়ান – যার ডানায়  ভর করে বেঁচে উঠবে এক নতুন দিনের স্বপ্ন –  এক অন্য ভারতবর্ষের স্বপ্ন । ওই উন্মত্ত দম্ভকে ঠেকিয়ে  একমাত্র  সেই পারে বাঁচাতে ওই রূপকথাকে। ]