ভোট বাজারের গল্প (১)

মধ্যরাতে বেডরুমের দরজায় টোকা। যদুদা শুনেও না শোনার ভান করলেন। কিন্তু তাতে কি! পাশে চৈতন্যরূপী বৌ শুয়ে আছে। 

– উফ এত রাতে আবার কে ? দ্যাখো না উঠে?
– ও কেউ না, সরকার। (যদুদার নিরুত্তাপ জবাব)
– মানে? কে সরকার ? আমাদের পাড়ার অখিল সরকার ? বলা নেই কওয়া নেই একবারে বেডরুমে !! (বৌদি উত্তেজিত)
– উত্তেজিত হয়ো না। পাড়ার নয়, দেশের সরকার , রাজ্যের সরকার। ভোটের আগে কটাদিন এরকম একটু চলবে। দেখছোনা কেমন চারিদিকে “পাড়ায় সমাধান” , “দুয়ারে সরকার”, “শ্মশানে সাবিত্রী”- কতো সব প্রকল্প, কত আয়োজন। এবার বোধহয় বেডরুমেই ঢুকে পড়লো !!
– মাঝরাতে তোমার এই বিশেষ টিপ্পনি গুলো না দিলেই নয়। যত গা জ্বালানো কথা !

 ইতিমধ্যে আরো বারকয়েক টোকা পড়েছে দরজায়। অধ্যৈর্য স্পষ্ট। 

– যাও না একবার উঠে দ্যাখো ।
– দেখার কি আছে ! বাড়িতে দুটো পোষ্য হনুম্যান আছে , তাদেরই একজন হবে। 

বলতে বলতে দরজা খুলে গেলো। ছোটো ছেলে ভুতু। মিশ কালো গায়ের রং। তার উপর ভূতের মতোই পোশাক – পুরোটাই কালো। গায়ের গন্ধ মোষের মতো । চোখ না খুলেও টের পাবে কে এলো। 

– (অন্ধকার থেকে ভুতুর গলা ভেসে এলো) পারোও মাইরি তোমরা। ভেতরে গুজুর গুজুর করছো, কিন্তু এদিকে আমার কথার উত্তর দিচ্ছো না। মেজাজটা খিচড়ে দাও সবসময়। যাকগে, গুড নাইট টা নিয়ে গেলাম। আমারটার রিফিল ফুরিয়ে গেছে। 

– গুড নাইট দিয়ে কি করবি ? এখনো শুবি না ? – মায়ের সস্নেহ প্রশ্ন।
– কাজ আছে। পড়তে হবে। 

পড়া না ছাই। হয় কোনো মেয়ের সাথে চ্যাট করবে , নাহয় উল্টাপাল্টা জিনিস দেখবে। তার ছেলেদের চিনতে বাকি নেই যদুর। মা-কে খালি ভুজুং ভাজুং দিয়ে বুঝিয়ে রাখা। 

দায়সারা উত্তর দিয়েই পা বাড়ায় ভুতু।
– দরজাটা কি খোলা রাখবো না বন্ধ করে যাবো ? বুড়োবয়সে কেন যে দরজা বন্ধ করতে হয় !

বাঁহাত দিয়ে অবহেলায় দরজাটা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলো ভুতু। শেষের কথাগুলো বৌদি শুনতে না পেলেও , যদুদার কান এড়ালো না। 

– কি বললো শুনলে ? “বুড়োবয়সে কেন যে দরজা বন্ধ করতে হয় ” ? বাপ -মা এর প্রতি কোনো ভক্তি শ্রদ্ধা নেই। কি জিনিস গব্বে ধরেছো দেখো?
– আমিতো শুধু ধরেছি , বীজ বুনেছে কে ? তোমার ওই দিনরাত চিড়বিড়িনি কথা বলার স্বভাব , ওটাইতো পেয়েছে। 

যদুদা ভাবলেন, এই মাঝরাতে পাটিগণিত বীজগণিত চর্চা না করলেও চলবে। মুখে বললেন – “যাকগে রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো”।
– হ্যাঁ , সেতো ঘুমোবই। তোমার মতোতো আর অম্বলের রুগী নোই যে সারা রাত জেগে ঢেঁকুর তুলবো আর মতলব ভাজবো, কি করে পরের পিছনে লাগা যায় । আবার বলছে “ঘুমিয়ে পড়ো” ! কি রাজপালংকে রেখেছো আমায় শুনি ? ঘুম আসে এতে শুয়ে ? কতদিন ধরে বলছি, ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে , বালিশটা চেঞ্জ করতে হবে। স্পন্ডেলাইটিসের জন্য স্পেশাল বালিশ বেরিয়েছে। মাত্র ৪০০০ টাকা দাম। কানে নিচ্ছ কথা ? সিগারেট কেনার পয়সা আছে , বালিশ কেনার পয়সা নেই !
– ঠিক আছে ঠিক আছে, আর কটাদিন একটু ধৈর্য ধরো, হয়ে যাবে ঠিক ।
– কেন ? লটারী লাগবে নাকি তোমার?
— হ্যাঁ, তা বলতে পারো – এ হলো গণতন্ত্রের লটারী । এইতো, যে স্পিডে সরকার ভিতরে ঢুকছে, আর দেরি নেই। পাড়া পার করে দুয়ারে এসে গেছে। বেডরুম অবধি এসে গেলেই চেয়ে নেবো দুটো স্পেশাল বালিশ । একটা তোমার, একটা আমার। 

এই বলেই পাশ ফিরে শুয়ে কানে বালিশ দিলেন যদুদা । কানের দুয়ারে ততক্ষণে হরিনাম সংকীর্তন শুরু করে দিয়েছে গৃহের সরকার। বয়সকালে হরি রাম বাম সব ভক্তিই ছুটে গেছে যদুদার। আপদকালীন দ্রুততায় তাই দুয়ারে আগল তুলে দিলেন তিনি।